দুর্নীতি ও ইসলামের দৃষ্টিতে তার প্রতিকার

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দুর্নীতি একটি নেতিবাচক শব্দ। নীতিবহির্ভূত সব কাজকেই দুর্নীতি বলা যায়। পরিভাষায় দুর্নীতি বলতে সাধারণত ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ,বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্পিত দায়িত্বের অপব্যবহার করা বোঝায়। কেউ কেউ বলেন, দুর্নীতি হলো অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ইত্যাদি। সাধারণত ঘুষ, বল প্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যক্তিবিশেষকে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা অর্জনের নাম দুর্নীতি।
দুর্নীতি দমনে ইসলাম : ইসলাম একটি সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম করার উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ইসলাম সবাইকে দুর্নীতিমুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার জন্য পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তির বিধান দিয়েছে। শুধু আইন ও বিধান দিয়ে সবক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। কারণ আইন প্রয়োগের রয়েছে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অন্যদিকে আইনে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফাঁক-ফোকর। তাই ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন ও শাস্তির বিধানের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যা মানবীয় সহজাত বৈশিষ্ট্যের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ। ইসলাম নীতি-নৈতিকতার ধর্ম। দুর্নীতি ও দর্বৃত্তায়নের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। দুর্নীতি দমনে মহানবী (সা.) শান্তি ও সুনীতির যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন,ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই বিদ্যমান দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব।
পার্থিব শাস্তির বিধান : ইসলাম অপরাধী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পার্থিব শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা দ্রুত কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলামে কোনো অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, এমনকি খুনির শাস্তি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রাখা হয়নি। কারণ এতে অপরাধীদের ভবিষ্যতে আরো বড় ধরণের অপকর্ম করার সুযোগে করে দেওয়া হয়।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি (অর্থাৎ,দুর্নীতিকারী যে-ই হোক না কেন,তাকে আইনের আওতায় আনা হবে,তার কোনো ছাড় নেই) ঘোষণা করেছেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।
হারাম-উপার্জনে নিরুৎসাহ করণ: অসৎ ও হারাম উপায়ে উপার্জনের প্রবণতা থেকেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। মহানবী (সা.) হারাম উপার্জনের প্রতি উম্মতকে নিরুৎসাহ করেছেন। আবু বকর (রা.)থেকে বর্ণিত, রাসূল(সা.) ইরশাদ করেছেন,‘হারাম দ্বারা বর্ধিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’(মিশকাত,পৃষ্ঠা-২৪৩) যে ব্যক্তি ১০ দিরহামে একটি কাপড় পরিধান করে,যার মধ্যে এক দিরহাম হারাম থাকে,তার পরিধানে ওই কাপড় থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তার নামাজ কবুল করেন না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৭৩২)
আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করা : আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করার দ্বারা অপরাধ দমন করা যায়। তাকে অবহিত করতে হবে যে এই জগৎই শেষ কথা নয়।এখানে মানুষের চর্মচোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখিরাতে আল্লাহর দরবারে সব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে অন্যায়,দুর্নীতি,অসদাচরণ ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার যথাযথ জবাবদিহি করতে হবে এবং পরিণামে জাহান্নামের বীভৎস আজাবের সম্মুখীন হতে হবে। যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। পরকালে জবাবদিহির ভয় মানুষের মনে যত বেশি কাজ করবে, সমাজের দুর্নীতিও তত কমে আসবে।
সুদ ও ঘুষ নিষিদ্ধকরণ : দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে প্রথমেই সমাজ থেকে সুদ ও ঘুষ দুর্নীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সমাজ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে রাসুল (সা.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতার প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন। জাবের (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) সুদখোর, সুদদাতা ,সুদের দলিল লেখক এবং সুদের দুই সাক্ষীর ওপর অভিশাপ করেছেন। (ইবনে মাজাহ,হাদিস : ২২৭৭)।
সততার সঙ্গে নিয়োগদান : রাষ্ট্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তিদের অসদুপায়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান। কর্মকর্তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পবিত্র আমানত।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নির্দেশ : প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মাধ্যমেও দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর থাকলে আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান সঠিকভাবে অব্যাহত থাকলে নিশ্চয় এই সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক কালোব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম : পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, দুর্নীতিও তত দিন থাকবে। সমাজকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা আদৌ সম্ভব না হলেও তা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে সেটি একমাত্র ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সম্ভব। যেমন হয়েছিল রাসুলে কারিম (সা.) এর যুগে ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে। ইসলাম দুর্নীতিকে সমর্থন করেনা। মানুষ দুর্নীতির এই ব্যাধি থেকে মুক্তি চাই। অতএব, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ার ভূমিকা পালন করলেই দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়া সম্ভব হবে।
শেষ কথা : একটি দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। আমাদের সমাজর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। এ দুর্নীতি ইচ্ছে করলেই একেবারে প্রতিরোধ সম্ভব নয়, দেশের সাধারণ জনগণ যত বেশি সচেতন হবে ধীরে ধীরে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সর্বপ্রথম নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে। মহান আল্লাহ সবাইকে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস, এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস ভাড়ার দাবি
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা