সুইজারল্যান্ডের চিঠি
বড় বিচিত্র মানুষের মন
গেল সংখ্যায় লিখেছিলাম ভাগ্যাহত নিপুর কথা, যার জীবনটা নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভিন্ন মোড় নিয়ে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজ এসে দাঁড়িয়েছে শক্ত এক অবস্থানে। এখন সে কেবল এক স্বাবলম্বী নারী নয়, সে এখন সম্পূর্ণ এক স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রত্যয়ী এক নারী। এখন তাকে আর জীবনের জন্যে আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়না। আনত মুখে, নীরবে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সইতে হয়না। এখন ভিন্ন এক নারী নিপু। সকাল থেকে বলা চলে রাত অবধি কাজ করে। সাপ্তাহিক ছুটির সময় কেবল নয়, ওয়ার্কিং ডে-তেও কাজ শেষে নিজ বাসায় না ফিরে সে যায় তার মায়ের কাছে, যে মা তার ভাষায় কথা বলে না, যে বিদেশিনী-মা তাকে নব-জন্ম দিয়েছে। “এই মা যদি আমাকে দেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে না আনতেন তাহলে হয়তো আমার অবশিষ্ট আর কিছু থাকতো না, এই প্রাণটুকুও হয়তো থাকতো না। এখন ভালো আছি, একা থাকি, প্রায়শ চলে যাই মায়ের কাছে। পাহাড়ের উপর তার ভিলা। সন্তানেরা বড় হয়েছে, এখানকার স্বাভাবিক নিয়মে তারা চলে গেছে এই বাড়ি ছেড়ে। মা থাকেন তার অনেকটা পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে,” গাড়ি চালাতে চালাতে বলে চলে নিপা। “এই মায়ের সাথে জানাশোনা ছিল আমার দাদার। দাদা সুইজারল্যান্ড এসেছিলেন পড়াশুনা করতে, এখন থাকেন আমেরিকায়। তার মাধ্যমে এই সুইস-মায়ের সাথে পরিচয়। তিনিই আমার জন্যে সুইস এম্বেসীতে আবেদন করেন, আমার যাবৎ ফর্ম পূরণ করে আমার সুইজারল্যান্ডে আসার ব্যবস্থা করেন।” নিপুর খুব ইচ্ছে আমরা একবার তার এই মাকে দেখে আসি। নিপুর বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব গাড়ি পথে আধ ঘন্টার মত, কিংবা তার চাইতেও কিছুটা কম। একেবারে পাহাড়ের উপর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সেই পাহাড়ে উঠার যে গাড়ি-পথ তা এত সংকীর্ণ যে নিপু যখন অনর্গল কথা বলতে বলতে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল, তখন শুনছিলাম বটে তার কথা, তবে মনে মনে ভয় যে ছিলনা তা নয়। গাড়ি যদি কোন কারণে একটু এদিক-ওদিক হয় তাহলে সাধের এই জীবনটা শেষ। কিন্তু নিপুর গাড়ি চালানো দেখে মনে হয়নি সে জাতীয় কোন ভীতি তার ভেতর কাজ করছিল। এ পথ যে তার খুব চেনা, সে যে এই পথে অভ্যস্ত। যে পথের কথা বলছি সেটি ঠিক গাড়ি চলারও পথ না। সেটি কংক্রিটের রাস্তা না। বোধকরি ওই বাড়ি পৌঁছার নিজস্ব শর্ট-কাট রাস্তা। ফিরে আসার সময় পাকা রাস্তা ধরে পাহাড় থেকে নেমেছি। তখন মনের সেই ভয়টা ছিল না।
সেদিনই আমাদের জেনেভা ফেরার কথা। বিকেলে ট্রেন। হাতে অনেকটা সময়। এর আগে সকালে নিপুর বাসায় ব্রেকফাস্ট সেরে সুমনা সহ বের হয়ে পড়ি ধারে-কাছের আর একটি দর্শনীয় স্থান দেখার জন্যে। নিপু সেই সাত-সকালে চলে গেছে আমাদের বিছানায় রেখে। কখন গেছে টের পাইনি। ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্টের সবকিছু সুন্দর-পরিপাটি রেখে সাজিয়ে গেছে। ঠিক যেন তার রেস্তোরাঁ। নিপুর বাসাটিও চমৎকার। ছোটখাট, কাঠের তৈরি, একজনের জন্য যথেষ্ট। সুজারল্যান্ডের ইন্টারলাকেন বা এদিকটায় বেড়াতে এলে এমনতর বাড়ি চোখে পড়ে। এদ্দিন দূর থেকে এই ধরণের বাড়ি কেবল দেখেছি , দেখেছি ছবিতে। কিন্তু এবার তেমন একটি বাড়িতে থাকা হলো নিপুর কারণে। ছোট ছোট জানালা, তাতে ঝুলানো কাপড়ের পর্দা। বিকেলে স্পিজের বিভিন্ন দিকটা ঘুরিয়ে দেখানোর পর নিপু যখন আমাদের তার বাসায় এসে নামালো তখন বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচ। তাকে আবার বেরোতে হবে, কাজে। আমাদের খানিক বিশ্রাম নেবার পালা। সম্মেলনের কারণে গেল কয়েক সপ্তাহ এক নাগাড়ে কাজ করতে হয়েছে। শরীর বলে একটুখানি ‘বিরাম’ দাও। শরীরের মালিক বলে ‘আমিও চাই’। কিন্তু শরীরের মালিকের যে সফর-সঙ্গী তার লক্ষ্য বাইরে বেরিয়ে পড়া। যাই হোক, নিপুর বাড়িতে ঢুকতেই ছোট্ট স্পেস পেরিয়ে তার রান্না ঘর, বাঁ দিকে বাথরুম, টয়লেট, ডান দিকে ড্রয়িং রুম, সেখানে একদিকে পিয়ানো, দেয়ালে মায়ের সাথে তার বড় আকারের একটি ফটো, ফ্রেমে বাঁধা। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে আর একটি কামরা, বেড রুম। সেখানে সিডি প্লেয়ার, পাশে অনেকগুলি গানের সিডি, একটি তাকে সাজানো। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দেই। বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে গাড়িপথ। তাতে মাঝে মধ্যে দু-দিক থেকে চলমান গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। বাড়ির সামনেই একটি অটোমেটিক পেট্রল পাম্প, সেখানে একটি জীপ পেট্রল বা ডিজেল ভরছে। কোন কোন কাউন্টার নেই। তার পেছনটায় পাহাড়। পাহাড় আর পাহাড় যেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। অদ্ভুদ ভালো লাগে। লো-ভল্যুমে রবীন্দ্র সংগীত শোনা আর বই পড়ার চমৎকার স্থান, পরিবেশ। মনে মনে ঠিক করি নিদেন পক্ষে আর একবার এই স্থানটিতে ফিরে আসতে হবে, কেবল বিশ্রাম নেয়া আর গান শোনার জন্যে। তাতে যদি ক্লান্তি আসে তখন হেঁটে বেড়াবো আশপাশ এলাকায়। যেমনটি করেছি সে সন্ধ্যায় সুমনা আর আমি।
তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। একদিকে পাহাড় আর একদিকে নদী। আমরা দুজন গায়ে শীতের কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় কদাচিৎ একটি, দুটি গাড়ি এগিয়ে চলেছে। লোকজন নেই বললেই চলে। নিপুর বাড়ির পাশেই একটি ছোট্ট ভলিবল খেলার মাঠ। তাতে আঁধো-অন্ধকারে একটি ছেলে একা বল নিয়ে খেলে চলেছে। আহারে, তার খেলার একটি সঙ্গীও নেই। ইচ্ছে করছিল তাকে সংগ দেই। অন্ধকারে তার চেহারা দেখা যায়না। এই শহরে কম বয়স্ক ছেলে-মেয়ে খুব একটা থাকে না। সবাই জেনেভা, জুরিখ, বার্নের মত প্রাণে ভরপুর বড় বড় শহরের দিকে চলে গেছে। এখানে যারা বাস করেন তাদের বেশির ভাগ বয়েসী। নিপুর সুইস মা-বাবার মত। আমরা লক্ষ্যহীন হেঁটে চলি পাশাপাশি। কদ্দুর যেতে দেখি একটি ছোট আকারের সুপার মার্কেট। বিকেলে যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন সুমনা এই সুপার মার্কেটে গিয়ে পাউরুটি সহ কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে এসেছিল, যদিও বা নিপুর বাসায় কোন কিছুর কমতি ছিলনা। সুপার মার্কেটের পাশে হোটেল, রেস্তোরা। রাস্তার মাথায় গোল চত্বরের একদিকে একটি ফুলের দোকান। তার সামনে পৌঁছে অবাক হবার পালা। কাঁচের বড় জানালা দিয়ে ভেতরে সাজানো ফুল, ছোটখাটো ফুল-গাছের টব চোখে পড়ে। দেখি দোকানের সামনে, পাশে বাইরের খোলা জায়গায় ফুলের গাছ, ফুল। তাদের গায়ে লেখা দাম। আপনি চাইলে দাম চুকিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশে তো বটেই, হল্যান্ড সহ ইউরোপের খুব কম দেশেই এমনটি দেখা যায়। একই দৃশ্য চোখে পড়লো পরদিন সকালে আমরা যখন ‘আসিরিয়াদ’ নামে পরিচিত একটি দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যাই। সেখানে পাহাড়ি পথে যেতে যেতে একটু দূরত্বে এক একটি বাড়ি। কোনো কোন বাড়ির রাখা ছোট ফ্রিজ। তার একটি খুলে দেখি তাতে দুধের পনীর। কেউ কেউ সেখান থেকে নিচ্ছেন এবং লেখা দাম অনুযারী তা একটি বাঙে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। সততার কী অনুকরণীয় উদাহরণ। যাই হোক, নিপুর বাসা থেকে কাছেই বাস স্টপেজ। সেখান থেকে বাসে চড়ে যাওয়া যায় আসিরিয়াদে। সুন্দর রৌদ্রস্নাত দিন। একেবারে ঝকঝকে সকাল। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি। আগেই বলেছি গোটা শহরটাই পাহাড়ের উপর। বাস আসার তখন মিনিট বিশেক বাকি। দেখি স্টপেজের পেছন দিকটায় অনেকগুলি সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। এরপর কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা দেয়া বিশাল খোলা সবুজ আর সবুজ মাঠ। সেখানে ঘাস খেয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে, যেন মনের সুখে, অনেকগুলি বিশালাকার নানা বর্ণের গরু-গাভী। তাদের প্রতিটির গলায় লটকানো পিতলের ঘন্টা। প্রাণীগুলি যখন নড়ে-চড়ে তখন শব্দ হয় টং টং। মিষ্টি সে শব্দ বিশাল পাহাড়ের গায়ে লেগে অপূর্ব এক দ্যোতনার সৃষ্টি করে। উপর থেকে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাই। একেবারে প্রাণীগুলির অনেকটা কাছাকাছি। ওরা নির্ভয়ে চড়ে বেড়ায়, আমার উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে। আমি তাকিয়ে থাকি, তাদের দিকে, পাহাড়ের দিকে। দৃষ্টি যতদূর যায় কেবল সবুজে-সবুজে ঢাকা মাঠ আর উঁচু পাহাড়। ইতিমধ্যে বাস আসার সময় হয়ে এলো বলে। আসিরিয়াদে পৌঁছে দেখি সেখানে আমাদের মত আরো বেশ কিছু পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারো কাঁধে ব্যাগ, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েও। বাস থেকে নেমে রাস্তা এগিয়ে গেছে পাহাড়ের দিকে। সেখানে বেশ কিছু বাড়ি, ফার্ম হাউস। সামনে মাঠে বিশালাকার গরু-গাভী চড়ে বেড়াচ্ছে। কদ্দুর এগুতেই চোখে পড়ে লেক। কী অপূর্ব সহাবস্থান -একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে লেক। এই পাহাড়ের শেষ কোথায় যেমন জানা নেই আমার, তেমনি জানা নেই এই ঢেউহীন জলরাশি কোথায় গিয়ে মিশেছে। এই বিশাল পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি। এমনি স্থানে এসে প্রকৃতির এই বিশালত্ব দেখে নিজেকে কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হয়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট