১২ নভেম্বর ২০২১, শেষ হল দু’সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু সম্মেলন। এটি ‘কপ-২৬’ নামে খ্যাত হয়েছে। সমাজ জীবনে বড় লোক যেমন গরীবকে মানুষ গণ্য করে না তেমনি বিশ্বের ধনী দেশগুলো এবার গরীব ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে রীতিমতো অপমান করেছে। বাঙালি সমাজে ভিক্ষুককে ভিক্ষা না দিয়ে বলে থাকি ‘মাফ করো’। ২০১৫ সালে প্যারিস কনসোটিয়ামে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন করে দেবে ২০২০ সাল পর্যন্ত। গ্লাসগোতে সবাই যখন ঐ টাকা কেন দেয়নি জিজ্ঞেস করল, তখন ক্ষতিকারক দেশগুলো বলল মাফ চাই- এই টাকা দেয়া সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশের মতো ছেয়চল্লিশটি দেশ চরম ঝুঁকিতে। এই ব-দ্বীপগুলো সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ইতোমধ্যে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে তাপমাত্রা প্রায় দু’ডিগ্রির কাছাকাছি বেড়ে গেছে। ফলে বিগত দ’শতাব্দীতে পানির নীচে চলে গেছে বহুদ্বীপ এবং নদী তীরের জনপদ। সন্দ্বীপ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ১. একবিংশ শতাব্দীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় শতাংশের মধ্যে আটকাতে হবে। ২. কয়লা, তেল, গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ, ইট, শিল্পপণ্য উৎপাদন বন্ধ করার রোডম্যাপ প্রণয়ন ৩. দায়ী শিল্পন্নোত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়। পরিস্কার কথা হলো, গত দু’দশকে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার যে বিষ্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে তার পেছনে ছিল শিল্পবিপ্লবে ব্যাপক হারে তেল, কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার। ফলে এই ধনী দেশগুলো এতোবেশী কার্বণ নিঃসরণ করেছে যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২ শতাংশ। বেড়েছে বায়ু দূষণ, নদী দূষণ, সমুদ্র দূষণ। গত অর্ধশতকে এই বড় লোকদের সাথে যোগ দিয়েছে চীন, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। এই তিনটি দেশ কয়লা ও তেল পুড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নিয়ে গেছে ১০ শতাংশের উপরে। কয়লা আর তেল পুড়িয়ে চীন আজ বিশ্ব মোড়ল। অথচ চীনের কয়লার ধোঁয়ায় গোটা বিশ্ব আক্রান্ত। কত দরখাস্ত, কত আবেদন, কত মিছিল, কত সম্মেলন। দিল্লী, বেইজিং আর ক্যানবেরা এসব দরখাস্ত সরাসরি খারিজ করে দিয়ে বলেছে, আগে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটুক তারপর বায়ুদূষণ আর তাপমাত্রার বিষয়টি আমলে নেয়া হবে। বাংলা ভাষায় এটাকে গোঁয়ার্তুমি বলা হয়। নভেম্বর ৭ তারিখে এসে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে একটি দলিল পেশ করে বলা হয় আগামীতে আর কোন কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প কোন দেশ স্থাপন করবে না। বাংলাদেশ সহ ৪৬ টি দেশ স্বাক্ষর করার পর অস্ট্রেলিয়ার কাছে নেয়া হলে, অস্ট্রেলিয়া স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। ভারত, চীন, আমেরিকা এই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করায় দলিলটিকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা ছাড়া অবশিষ্ট কিছু ছিল না।
৩১ অক্টোবর থেকে গ্লাসগোতে দু’টো অনুষ্ঠান হয়েছে। একটি হলো অপরাধী ধনী দেশগুলোর জমজমাট পিকনিক। কারণ ধনী দেশগুলোর শাসকরা যে পিকনিক ভালোবসে। অন্য দিকে হাজার হাজার পরিবেশ কর্মী ও বাকি রাষ্ট্রপ্রধানদের দরখাস্ত আর কান্নাকাটি। কারণ এরা যে গরীব বা উন্নয়নশীল দেশ। এই কান্নাকাটি শুরু ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলন থেকে। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন বনকে রক্ষা করতে ব্রাজিলকে অনুরোধ করা হল। ব্রাজিল কর্কশ ভাষায় বলেছিল, আমাজনের গাছ না কাটলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। হ্যাঁ, যদি আমাজনের গাছ না কাটার জন্য বাকি বিশ্ব ক্ষতিপূরণ দেয়- তবে ব্রাজিল অবশ্যই গাছ কাটবে না। টাকাতো কেউ দিল না। এবং ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ঐ প্রসঙ্গ আর সামনে আনলো না। হক কথা বললে, হক দাবি করলে এভাবে বিশ্ব মোড়লরা চুপ মেরে যায়।
প্রায় গোটা ইউরোপ ঘুরে বুঝলাম, এই উন্নত বিশ্ব নিজেদের প্রকৃতিকে স্বর্গতুল্য গড়ে তোলার পেছনে দুটো অপরাধ কর্মকাণ্ডই ভিত্তি। প্রথমটি হলো ইউরোপ প্রায় পাঁচশ বছর পৃথিবী ভাগ করে শাসন ও শোষণ করে পৃথিবীর ধনসম্পদ জমা করেছে ইউরোপ। দ্বিতীয়ত গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে গোটা পৃথিবীকে বাজারে পরিণত করেছে। এখনো অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে সমস্ত ডলার, পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছে আমেরিক।
ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন। বিনিময়ে দিচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড। ওজন স্তরে ফুটো দেখা দিয়েছে বহু আগে। সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি ভূ-পৃষ্ঠে আঘাত হেনে নিয়ে যাচ্ছে গণ বিলুপ্তির দিকে। অনিন্দ্য সুন্দর এই পৃথিবী ছাড়া বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এই ধরণীতেও পাঁচবার প্রাণের গণ বিলুপ্তি ঘটেছে। এর মধ্যে বরফ যুগে গণ বিলুপ্তি আর মহাজাগতিক আঘাতে ডাইনোসর সহ প্রায়সব প্রাণীর বিলুপ্তি হয়েছিল। পাঁচটি গণ বিলুপ্তিই ছিল প্রাকৃতিক অনিবার্যতা। কিন্তু পৃথিবী আজ ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির মুখোমুখি শুধুমাত্র মানুষ তথা তথাকথিত উন্নত বিশ্বের অপরিনামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে। অতীতের গণ বিলুপ্তিগুলোতে তেলাপোকা সহ বেশ কিছু প্রাণী রক্ষা পেয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই মুহূর্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি থামানো না গেলে ষষ্ঠ গণ বিলুপ্তিতে কোন প্রাণীই রক্ষা পাবে না। প্রায় চূড়ান্তভাবে মনুষ্য প্রজাতির গণ-বিলুপ্তি ঘটে যেতে পারে। এতো হতাশা জনক ফলাফল নিয়ে কেউ বাড়ি ফিরতে চায়নি। মশকরার সীমা রইলো না। লাগেজ গোছাতে গোছাতে ধনী দেশগুলো বলল, আগের টাকা মাফ করে দিও। এবার ক্ষতিপূরণ দেবো- তবে ২০২৩ সাল থেকে। স্টিফেন হকিং আগে বলেছিলেন, মানবজাতির হাতে একশ বছরের বেশি সময় নাই, গণশত্রু উন্নত তথাকথিত বিশ্ব কি মানবজাতিকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে?
লেখক : কলামিস্ট; আইনজীবী হাইকোর্ট