সুইজারল্যান্ডের চিঠি
আত্মপ্রত্যয়ী এক নিপুর ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী (৪)
বিয়ে হয়েছিল তার স্কুল বয়সে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া আর পাঁচ-দশটা গ্রামীণ মেয়ের জীবন যেভাবে চলে তেমনি চলছিল তার সাদামাটা জীবন। ইতিমধ্যে সংসারে এলো ফুটফুটে একটি মেয়ে। কিন্তু উপরওয়ালা বুঝি তার জীবনটা অন্যভাবে লিখে রেখেছিলেন। সুখ তার বেশিদিন সইলো না। তার নতুন-জীবনের রঙিন স্বপ্ন বেশিদিন ঠিকলো না। স্বামীর সংসারে, স্বামী, তার আত্মীয়-স্বজনের কেবল মানসিক নয়, শারীরিক অত্যাচার তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললো। এমন কী তাকে মিথ্যে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তাকে পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হলো। প্রচন্ড সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও জেদী এই মেয়েটি, কতই বা তখন বয়স হবে, সব অত্যাচার, হুমকি, ভয়কে জয় করে এক সময় শ্বশুরবাড়ি, গ্রাম এমন কী দেশ ছেড়ে চলে এলো ইউরোপে। রেখে আসতে বাধ্য হলো তার কলিজার টুকরো, তার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে। এখন মেয়েটি বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে। তার ছবিও দেখালো এই অসম-সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী মহিলাটি। তার সাথে এই আমার প্রথম দেখা। প্রথম দেখায় সে তার ফেলে আসা জীবন, মৃত্যুর মুখ থেকে তার ফিরে আসা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, আজকের অবস্থানে পৌঁছানো- সব এক এক করে বলে চলে। আমি নির্বাক। কেবল অবাক হয়ে শুনি। অবাক হই এই ভেবে মানুষ, নিকটজন কী করে তার সাথে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে। সেই অজপাড়া গাঁয়ের মেয়েটির সাথে আমার প্রথম দেখা মাস দেড়েক আগে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। যে সম্মেলনে আমার যাওয়া সেই একই সম্মেলনে সেও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল তাতে যোগ দিতে। এসেছিল প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার পথ নিজের গাড়ী চালিয়ে। নিপু তার নাম। জেনেভায় ব্যস্ত ছিলাম, তার সাথে কথা বলার, পরিচয় হবার সুযোগ হয়নি। পরিচয়, কথা বলা, তার ফেলে আসা অতীতের কথা, তার জীবন-সংগ্রামের কথা এবং আজকের অবস্থানে পৌঁছার সব কাহিনী শুনলাম তার শহরে গিয়ে। তার গাড়ীতে তার শহরের এদিক-ওদিক সে যখন আমাদের অর্থাৎ সুমনা ও আমাকে নিয়ে ঘুরছিল তখন। দেখে মনে হলো, তার মনের ভেতর পুঞ্জীভূত ব্যাথার কথা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে সে নিজেকে কিছুটা হালকা বোধ করছিল। নিপুকে জানা হতো না, জানা হতো না এক অসহায় মেয়ের করুন কাহিনী যদি তার শহর, স্পিজে আমাদের যাওয়া না হতো।
জেনেভায় সম্মেলন শেষ। হাতে আরো তিনদিন সময়। ঠিক হলো পরদিন আমরা জেনেভার বাইরে কোন শহরে যাব, যেখানে নদী আর পাহাড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে চলেছে। সুমনাই সব ঠিক করলো, স্থান নির্বাচন, হোটেল থেকে শুরু করে ট্রেনের টিকেট সব। টিকেট কাটার পর জানতে পারলাম সেই শহরে থাকে নিপু। আমরা যাচ্ছি শুনে সে বলে, কিছুতেই হোটেলে থাকা চলবে না, আমার বাসায় আমি একা। আপনারা সেখানে অবাধে থাকতে পারবেন। আমার কিছুটা দ্বিধা ছিল। সাধারণত বাইরে অর্থাৎ ভিন দেশে কাজে বা বেড়াতে গেলে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে থাকায় খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনে। নিষেধ সত্বেও ওই শহরের রেল স্টেশনে নিপু গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। স্পিজ ছোট্ট শহর, পটে আঁকা ছবির মত, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬২৮ মিটার উঁচুতে এই শহরে মাত্র ১৩ হাজার লোকের বসবাস। নিপু তারই একজন। সুইজারল্যান্ডের সবচাইতে দীর্ঘ লেইক যা ‘থুন লেইক’ নামে পরিচিত তার পাড়েই চোখ-ধাঁধানো এই চমৎকার শহরটি। অনেকে এই শহরটির নাম শুনে নাও থাকতে পারেন, তবে যারা সুইজারল্যান্ড এসেছেন বেড়াতে তাদের হয়তো ‘ইন্টারলাকেন’ নামটি চেনা। ‘কেবল-কার’ দিয়ে যেন আকাশের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া- আর সেটি এই ইন্টারলাকেনে। এই শহরের কাছাকাছি স্পিজ। এই শহর আর একটি কারণে বেশ পরিচিত। ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে যেবার ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা হয়েছিল, তখন জার্মান দল ষ্পিজ শহরের ‘হোটেল বেলফাদেরে’ (আমার ভুল ফরাসি উচ্চারণের কারণে বানান ভুল হতে পারে, ক্ষমা মার্জনীয়) ছিল এবং মজার ব্যাপারে সে বছর জার্মান দল বিশ্ব কাপ জিতেছিল। স্পিজ পৌঁছার আগের পথটির অভিজ্ঞতাটি ছিল চমৎকার। বিশেষ ছোট আকারের ট্রেন। ধীরগতিতে চলে, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেড়িয়ে, কখনো ট্রেনটি ঢুকে পড়ে উঁচু পাহাড়ের টানেলে। চারিদিক গভীর কালো অন্ধকার, কিন্তু ট্রেনের ভেতর যাত্রীদের টেবিলের উপর ছোট একটি টেবিল ল্যাম্প। এই বিশেষ ট্রেনটির নাম ‘গোল্ডেন পাস’, প্রতিটি সিটের রয়েছে নির্দিষ্ট নম্বর, সেই হিসাবে আপনি আপনার আসনে বসতে পারেন। এই জন্যে আগ-বাড়িয়ে ‘রিজার্ভেশন’ করার প্রয়োজন। জেনেভা রেল স্টেশন থেকে আমরা স্বাভাবিক ট্রেনে ঘন্টা দুয়েক চলার পথ মন্ট্রেঙ স্টেশনে নেমে পড়ি। সেখান থেকে বিশেষ ট্রেন ‘গোল্ডেন পাস’। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে এগিয়ে চলে কিছুটা ধীরগতিতে। অদ্ভুত সে ভাললাগা, যেন আকাশের কাছাকাছি চলেছে এই ট্রেন। ঘন্টা দেড়েক চলার পর ট্রেন এসে থামে সুয়েসিমেন স্টেশনে। তখন সুন্দর সকাল, ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর বারো। আমাদের আবার ট্রেন ধরতে হবে স্পিজ যাবার জন্যে। পরবর্তী ট্রেন ছাড়বে আধ ঘন্টা পর। স্টেশন লাগোয়া একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে কফি-স্ন্যাকস খেয়ে কাছাকাছি হাঁটাহাঁটি করি। লোকজন তেমন নেই। কিছু ট্যুরিস্ট, কাঁধে ব্যাগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের আরো পৌনে এক ঘন্টা চলতে হবে ট্রেনে, তবেই গন্তব্যস্থল। ইতিমধ্যে নিপু ফোনে কয়েকবার সুমনার কাছ থেকে জেনে নিলো আমরা কদ্দুর। তার এক কথা সে স্পিজ রেল স্টেশনে আসবে আমাদের নিতে।
রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই দেখি নিপু দাঁড়িয়ে। নাছোড়বান্দা। এগিয়ে যাই পার্কিং প্লেসের দিকে, সেখানে নিপুর গাড়ি। আগেই বলে রেখেছিল তার রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারতে হবে। দুপুরে লাঞ্চ বলতে যা বুঝায় তা কখনো সারা হয় না। ছোটখাট রেস্তোরাঁ, ছিমছাম। চমৎকার লোকেশন। কাচের দেয়াল, দৃষ্টি মেলে দেই বাইরে। বর্ণনা করি সে ক্ষমতা নেই। এক শব্দে কেবল বলতে পারি, চমৎকার। পাহাড় আর নদীর কি অপূর্ব সংমিশ্রণ। দৃষ্টি ফেরানো যায়না। লাঞ্চ সেরে নিপু আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহর দেখানোর জন্যে। তার কাজের ভিড়ে আমাদের নিয়ে সে কী করবে, কী খাওয়াবে এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝে দুপুরে তার ব্রেক। সন্ধ্যের সময় তাকে আবার ফিরে আসতে হবে কাজে। বলে, ‘গাড়ির চাবি রইলো আপনাদের কাছে। আপনারা শহর ঘুরে দেখুন।’ ইতিমধ্যে আমাদের হোটেল থাকার প্ল্যান বাতিল করতে হলো নিপুর পীড়াপিড়িতে। তাকে বলি, ‘আমার কিছুটা বিশ্রাম দরকার। তার চাইতে এই ভালো কিছুক্ষণ তোমার গাড়িতে ঘুরে বেরিয়ে তোমার কাজের সময় হয়ে এলে আমরা তোমার বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেব।’ নিপু গাড়ি চালায় অতি দক্ষতায়, দ্রুত গতিতে, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে। একটা সময় আমাদের নিয়ে সে পৌঁছে একটি ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। নাম ‘সিগ্রিসবিল সাঁকো’। টিকেট কেঁটে হেঁটে যাওয়া যায় ৩৪০ মিটার দীর্ঘ ও ১৮২ মিটার উচ্চতায় এই ব্রিজের উপর দিয়ে, ওপারে। হাঁটার সময় ব্রিজটি নড়ে, যেন এখনই বুঝি ছিঁড়ে গভীর খাঁদে গিয়ে পড়বে। অনেকেই পার হতে ভয় প্রায়। দেখলাম এক ইউরোপীয় যুগল কদ্দুর গিয়ে ফিরে আসছে। বলি, ‘ভয় পাচ্ছ’? মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ। টিকেট কাটতে চাইলে নিপু সুইস ভাষায় কাউন্টারে বসা বয়স্ক লোকটিকে কী যেন বললো। শুনে আমার হাত থেকে টাকাটা নিতে গিয়েও লোকটি নিলোনা। নিলো নিপুর কাছ থেকে। টিকেট হাতে নিয়ে নিপু হেসে বলে, ‘তাকে বলেছি, তুমি যদি চাও আমি আরো গেস্ট নিয়ে আসবো সামনে, তাহলে তুমি ওনার কাছ থেকে টাকা নেবেনা।’ সাঁকোটি পার হয়ে আমরা হাঁটতে থাকি পাশাপাশি। নিপু বলতে শুরু করে তার ফেলে আসা দুঃখের দিনগুলির কথা। বলে, ‘আজ আমি স্বাবলম্বী। একা থাকি, চাকরি করি, গাড়ি চালাই, মাউন্টেন বাইক চালাই, স্কেটিং করি বরফের উপর, ম্যারাথন দৌড়ে নিয়মিত অংশ নেই, বঙিং, ক্যারাটে শিখেছি এবং নিয়মিত জগিং করি, দৌড়ে উঠে যাই এই বড় বড় পাহাড়ের উপর,’ বলে দেখায় কাছের একটি পাহাড়। অথচ আমি ছিলাম গ্রাম্য বধূ, এক কন্যা সন্তানের মা। এক কঠিন ও চরম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পার হওয়া আমার এই জীবন আমাকে এই সব শিখিয়েছে। অথচ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন আমি সুইজারল্যান্ড আসি তখন আমি না জানতাম ইংরেজী, না জানতাম সুইস ভাষা। পারিবারিক (স্বামীর সংসারে) অশান্তি, মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে আমাকে দীর্ঘদিন। আমার বিরুদ্ধে হত্যার মিথ্যে অভিযোগ এনে পুলিশ দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করানো হয়েছে। সে ঘটনায় নিজ স্বামীর সাথে স্থানীয় প্রভাবশালীদেরও হাত ছিল। আমার কাছ থেকে আমার ছোট্ট মেয়েটিকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ওদের প্ররোচনায় পুলিশ আমাকে ‘রিমান্ডে’ নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে আমার কাছ থেকে মিথ্যে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চেয়েছিল। বোধকরি উপরওয়ালা ছিলেন। আমি সমস্ত ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। সক্ষম হই দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে। না হলে হয়তো আমি মারাই যেতাম। বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ড আসার পেছনে ছিলেন আমার মা, এরিকা ভন কানেল। তার কাছে যে আমি চিরদিনের ঋণী। দেশে জন্মদাত্রী মা-কে ফেলে এসে আমি পেলাম আমার নতুন মাকে। পেলাম নতুন জীবন। এই ভালো।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট