বঙ্গবন্ধুর অসামপ্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদ

পিংকু দাশ | শনিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে গত ২৬ মার্চ। এ বছরই আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। অসামপ্রদায়িক ও মানবতাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশষে সবার প্রিয় মানুষ হিসেবে আজীবন হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছেন, থাকবেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল আদর্শ ছিল অসামপ্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। এ আদর্শের উপর ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মর্াচের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক অসামপ্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ- খ্রীস্টান সব সমপ্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে এদেশ স্বাধীন করেছে। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বৈশ্বিক মহামারী করোণা ভাইরাস সহ নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে যখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করে বিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করেছে, তখন স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী সামপ্রদায়িকগোষ্ঠী সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি, স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেশের সুনাম নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার মূল কথা ছিল অসামপ্রদায়িক দেশ। কিন্তু এখনো দেশে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার নামে সহিংসতা, হত্যা, লুটতরাজ ও ধর্ষণের মত অপরাধ ঘটছে। এমনকি বাঙালির মুক্তির এই মহানায়কের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের দিন ১৭ মার্চেও সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে ভয়াবহ সামপ্রদায়িক সহিংশতায় প্রচুর হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দির পোড়ানোর মত দুঃসাহস দেখিয়েছে উগ্র সামপ্রদায়িকগোষ্ঠী। সমপ্রতি কুমিল্লা, রংপুর, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারাদেশে ধর্মীয় সহিংসতায় প্রচুর বাড়ি ঘর, মন্দির, উপসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা এবং ধর্ষণের মত ভয়াবহ সামপ্রদায়িক হামলায় হিন্দুদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজায় বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে করে দেশের হিন্দু সমপ্রদায় শংকিত এবং আতংকিত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় অসামপ্রদায়িক মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে দোষীদের শাস্তি দাবি এবং সমপ্রীতি সমাবেশের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহস যুগিয়েছে। দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দূরদর্শিতায় বরাবরের মত অপরাধী এবারও ধরা পড়েছে। কিন্তু হিসাব করে দেখলে ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সামপ্রদায়িক হামলার বিচারের রায় ঘোষণা হয়নি। ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দীন উপজেলায়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুমন্দির ও বাড়ি ঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। ২০১৪ সালে যশোরের অভয়নগরে সংখ্যালঘু পরিবারে হামলা এবং ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধপল্লীতে, হামলা, ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে । এসব ঘটনার কোনটারই সঠিক বিচার হয়নি। তাইতো অপরাধীরা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারবার এধরনের সামপ্রদায়িক সহিংসতা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তারঁ স্বপ্নের বাংলাদেশকে অসামপ্রদায়িক এবং মানবতাবাদী দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু। অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার, যেখানে থাকবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনার বরপুত্র। তাইতো ১৯৭৩ সালে ফেব্রয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি, যে কোনদিন আর শোষকরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। আমি বাঙালি, বাঙালি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই সম্মানের সঙ্গে। আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, মানে ধর্মহীনতা নয়’। অর্থাৎ তাঁর স্বপ্ন একটি অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্ম চর্চা করবে। তিনি আরো বলেছিলেন পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।

১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিলেন আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে। তখন এই মুক্তিসংগ্রামের মহানায়কের সাথে দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন একই সম্মেলনে অংশ নেয়া কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’। সম্মেলনে বৈঠক হয় লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে। তারা বঙ্গবন্ধুকে শর্ত দেন বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করলে তারা স্বীকৃতিসহ সবধরনের সহযোগিতা দিবেন। বঙ্গবন্ধু অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, এটি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ মুসলমান অমুসলমান সবার দেশ। সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এর সঙ্গে কখনো আপস করেননি।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, রাজনীতিতে যারা সামপ্রদায়িকতা সৃষ্টি করে তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনদিন সামপ্রদায়িক হতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সামপ্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর অসামপ্রদায়িকতা পাশ্চাত্য ধারণার মতো ধর্ম বিবর্জিত ছিল না’।
বঙ্গবন্ধু সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন। তবে সামপ্রদায়িকতাকে তিনি বর্জন করেছিলেন। অন্য ধর্ম ও মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা ধার্মিকের বড় গুণ। অসামপ্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তার পক্ষে সকল বাঙালিকে এক করা সম্ভব হয়েছিল। ধর্মীয় বিরোধ উপেক্ষা করে হিন্দু- মুসলিম- বৌদ্ধ- খ্রীস্টান সকলকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানতেন যে ধর্মীয় বিরোধের কারণে সামপ্রদায়িকতার উদ্ভব হয়। তাই ধর্মীয় বিরোধ রোধকল্পে সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য ক) সর্বপ্রকার সামপ্রদায়িকতা, খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল না। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বিএনপি শাসনামলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল না। স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ তার অবৈধ শাসনামলে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও অসামপ্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করছেন। তাই স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সারা বিশ্বের কাছে রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক বাংলাদেশকে অসামপ্রদায়িক এবং মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনুকরণীয় নিদর্শন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে