(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রামপুরা
বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা ঢাকা। এই কথাটা শুনে আসছি সম্ভবত দশ/এগার বছর বয়স থেকে। তখন টিভি বলতেই ছিল ঐ বিটিভি।
‘সিঙ মিলিয়ন ডলারম্যান’ দেখে ঠিক লি-মেজরস্ এর মতন করে দৌড়ানোর চেষ্টা করতাম। সিনেমাটির এতো ভক্ত হয়ে গেলাম যে, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম আমি উড়ছি; যতটুকু ইচ্ছা ততটুকুই উপরে উঠছি আবার নামছি।
আর ‘সলিড গোল্ড’ ছিলো আমাদের দেখা প্রথম মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম, এখানে ৭৯/৮০ সনে Dire Straits এর Sultan of Swing এর লাইভ ভার্সনটা দেখেছিলাম।
যাক্, আমি এখন গিটার নিয়ে যাচ্ছি রামপুরার উদ্দেশ্যে সাথে বন্ধু র্যমুয়েল ওয়াল্টার থমাস। তাকে বাংলাদেশের আধুনিক সঙ্গীতের একজন এঙপার্টই বলা যেতে পারে। একদিকে সুবীর নন্দী, মাহমুদুন্নবী, বিভিন্ন সিনেমার গান; অন্য দিকে ঐ বাংলার মান্না দে, কিশোর কুমারের গান তার নখদর্পনে।
গতকাল বিটিভি থেকে ফোন এসেছিল- আপনি কি পাভেল আহমেদ বলছেন? আগামী ১০ মার্চ সকাল ১০টায় আপনার অডিশন।
বিটিভির অডিশনে অনেকগুলো নিয়ম-শৃঙ্খলা না বলে, বিধিনিষেধ আছে বললেই ঠিক হবে। প্রথমত ভারতীয় শিল্পীদের গান করা যাবে না। এই বাংলার আধুনিক সঙ্গীত বলতে তারা বুঝেন- মাহমুদুন্নবী, আবদুল হাদী, বশীর আহমেদের গান।
সোল্স, রেনেসাঁর গান করলে বলবে আবার ব্যান্ড সঙ্গীত। আবার ফোক্ ইনফ্লুয়েন্সের কোন কিছু করা যাবে না। এগুলো একধরনের দাবা খেলার কুটিল চালের মতন কৌশল- অর্থাৎ একটি পিস্কে বিশপের মতন কিছু একটা দিয়ে পিন করার মতলব। অডিশন রুমে হোমড়াচোমড়া গোছের পাঁচ-ছয়জনকে দেখলাম। আমি আসিফ ইকবালের স্বপ্ন জড়ানো গানটা করলাম। তারা বললো, এটাতো ব্যান্ডের গান।
আমি বললাম এটা নকিব খানের সলো এ্যালবামের গান। শেখ ফরিদি বললেন, আপনি একটা সিনেমার গান ধরুন, তাঁর কথায় বাকী বিচারকরাও সায় দিলেন।
সিনেমার গান আমি অনেক জানি কিন্তু সেগুলো গাওয়ার মত মনমানসিকতা আমার নেই। আমি অন্য আরেকটি গান করলাম।
সিনিয়র একজন বললেন, দেখুন বিটিভিতে গান গাইতে হলে আপনাকে আমাদের পছন্দের গান গাইতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে বিটিভির গতবাঁধা গানগুলো। যে যতটুকু জানে কেউ সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে চায় না। এদের মূল উদ্দেশ্য নিজের চাকরি আর যার যার অবস্থান ধরে রাখা। আসলে বিটিভি বাংলাদেশের মিউজিকের একটা বড় সমস্যা। কারণ বিবর্তনহীন শিল্পের ভবিষ্যত যেমন অন্ধকার, তেমনি প্রয়োজনহীন। ওয়াল্টারের ভাষায়- বিটিভির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
গান নিয়ে ওয়াল্টারের অনেক দুঃখ। সে মনে করে, আজ যারা প্রতিষ্ঠিত আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী তাদের অনেকের চাইতে সে অনেক ভালো গান গাইতে পারতো।
এক সময় গণ সঙ্গীত মাতানো গায়ক ওয়াল্টার আজ ভীষণ হতাশ। সে বলে, সুযোগ না পেতে পেতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি তাই আগের মতন গান গাইতে পারি না।
আমরা ফার্মগেইটে এসে থামলাম। একটা হোটেলে চা খেয়ে ওয়াল্টারকে বিদায় দিলাম। সে মিশে গেল ফার্মগেইটের হাজার মানুষের ভিড়ে।
আমি ভাবলাম, ওয়াল্টারের মতন একটা মানুষ গান না গাইলে কি হবে? ঠিকই নতুন কেউ তার জায়গা দখল করে নিবে। হতে পারে সে ওয়াল্টারের চেয়ে ভাল বা মন্দ। আর আমি মিউজিক না করলে কি ঢাকায় মিউজিক থেমে থাকবে? বাবা বলতেন- আমি-তুমি মারা গেলে আগামীদিন ঠিকই গাড়ির চাকা ঘুরবে।
হোটেল রুপসী বাংলা
ফেইসবুকে বন্ধু মিলনের সাথে আলাপ হচ্ছিলো, সে ঢাকায় আসবে আজ বিকেল ৪টার মধ্যে। মোবাইল ফোনের ইনবঙ-এ গতকালের জমা হওয়া মেসেজ। একটি নতুন মোবাইল ফোনের লাউঞ্চ হবে হোটেল রুপসী বাংলায় (অর্থাৎ পুরানো শেরাটন হোটেলে) বিকেল ৩টায় আমি আমন্ত্রিত। লাঞ্চ করে বাস স্ট্যান্ডে নেমে অনেক কষ্টে একটি সিএনজি পেলাম, পেলাম বটে তবে প্রাইভেট। সিএনজির গায়ে অদ্ভুত ভুল বানানে লেখা চৎবাবঃ। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে হাতির পুলের পাশে মোতালেব প্লাজার সামনে দাঁড়ালাম। বন্ধু মিলন আসলো আরো ১০/১৫ মিনিট পরে। সে লাঞ্চ করছিলো মালঞ্চ রেস্টুরেন্টে। আমি তাকে বললাম জানিস, এখানেই কিছুদিন আগে একজন আদম বেপারী একটি তরুণীকে ছাব্বিশ টুকরো করে মেরেছিলো। মিন্টু আঁতকে উঠলো এখানেই? সেটা আগে জানলে তো এখানে খেতে আসতাম না। সিএনজি ওয়ালাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ‘রুপসি বাংলায়’ গিয়ে থামলাম। পকেটের অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ করে ড্রাইভারকে দুশ টাকা দিয়ে যখন আমরা হোটেল চেক পোস্টের সামনে তখন ঠিক ৩.৩০ মিনিট।
টিংকু ভাই খুব ব্যস্ত। আমাকে তার প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে সম্বোধন করলেন আর বল্লেন, ওস্তাদ এতো দেরি কেন?
ওস্তাদ একট টিশার্ট গিফ্ট আছে। দেখলাম টিশার্ট নেওয়ার জন্য ভদ্র মানুষদের বিশাল এলোমেলো কিউ। উইন্টার গার্ডেনের ভিতরে উঁকি মারলাম। এসির ঠান্ডা বাতাসের ভিতর লোকে-লোকারণ্য।
সবাই কফি, স্যান্ডউইচ খাচ্ছে, আমি আর মিলন কিছু খেলাম না।
ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁকড়া চুলের রুবেল হেসে বললো- ভাই এই নেন, আমি এখন এই চ্যানেলে আছি। একটা রিয়েলিটি শোয়ের জন্য আপনাকে অ্যাংকর করতে চাচ্ছি। আমি উত্তর দিলাম, উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলেই আমি প্রস্তুত। রুবেল বললো, না বস্ টাকা পয়সা নেই, তবে আপনাকে চাঁটগার ভাষায় আলাপচারিতা করতে হবে। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, নকীব খান এরা হবেন মূল শিল্পী। আমি বললাম, চট্টগ্রামে আরো অনেক শিল্পী আছে তাদের কাউকে কি সম্পৃক্ত করা সম্ভব না?
রুবেল চলে গেল। সন্ধ্যা নামলো খুব তাড়াতাড়ি। হলের মাঝে আমি, টিংকু ভাই আর চুলবিহীন তুষার ভাই। সাউন্ড চেক হচ্ছে- হ্যালো হ্যালো ওয়ান, টু, থ্রি, ফাইভ। চিংশে আমার অনেক দিনের পরিচিত। সে কাজ করে সাউন্ড-মেশিনে প্রায় এক যুগ ধরে। সে আমাকে বললো, বস আজকে শিলার গান আছে। আমারও কৌতূহল হলো, তরুণী শিল্পী শিলার নাম শুনেছি অনেকদিন কিন্তু কোনদিন গান শুনিনি।
কালো টিশার্ট, কালো জগিং টাইপ ট্রাউজার পড়া শিলা আসলো স্টেজে। তার পাশের কিবোর্ড প্লেয়ার তুষার ভাই আমার অনেক দিনের পরিচিত। তুষার ভাই বেশ ভালো বাজায়, ঢাকায় যারা এখন মূলধারায় কাজ করছে তাদের মাঝে তুষার ভাইয়ের বাদনে একটা ওয়ার্ল্ড মিউজিকের ছোঁয়া লক্ষ করা যায়। তার পাশে হাতাকাটা বেইজিস্ট, মুখে লম্বা দাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে ‘ইয়েস’ ব্যান্ডের কেউ। শিলার কপালে, চিবুকে, ঠোঁটে অর্থাৎ মুখের অনেক স্থানে মেটাল জাতীয় কিছু গাঁথা।
বন্ধু মিলন চাঁটগার ভাষায় বলে উঠলো, ইবে না শিলা? ইবেরেতো সাঁটগাত গান গাইতে দেক্কি।
গান শুরু হলো বাবু রাম সাপুরে… আই বাবা দেখে যা…
তারপর কিবোর্ড পিস্, মন্দ নয়।
এবার শুরু হলো শিলার কথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে একেকটা চিৎকার দিচ্ছে আর বলছে, আসুন আমরা নাচি। কিন্তু কোনো দর্শক শ্রোতা নাচতে আসল না। ছোট্ট মেয়েটা এবার স্টেজের ওপর কয়েকটা তিড়িং বিড়িং লাফ দিয়ে বলে উঠলো, আমি হচ্ছি ইয়াং আর আপনারা শ্রোতারা হচ্ছেন বেশীরভাগ চল্লিশার্ধ তাই আমাদের কেমিস্ট্রি মিলছে না।
একজন দর্শক স্টেজের সামনে আসতেই শিলা নীচে নেমে এসে তার কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা দিল, লোকটি বলল, বয়স আমার যাই হোক আপনি যদি ভালো গান গাইতে পারেন তাহলে তা আমাদের উচ্ছ্বসিত করতে বাধ্য। শিলা এবার বললো, তাহলে আপনিই আসুন স্টেজে…
এভাবে অনেক কথার ফাঁকে ফাঁকে সে তার জনপ্রিয় গান ‘রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া’… ধরলো। এই গানটার রেকর্ডিং ভার্সনে শিলার কণ্ঠে ভোকোকর্ড, ফ্লেঞ্জার ইত্যাদি অত্যন্ত চাতুরতার সাথে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু লাইভ শোতে সেটির অবকাশ নেই বলে শিলার কণ্ঠ বিরক্তিকর আর বেসুরোই মনে হচ্ছিলো।
সবাই মুখে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো। একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখা গেল শিলার সাথে নাচতে। শিলা বাচ্চার বাবাকে বলল- হইসে, অনেক হইসে এবার নাচতে আসেন…… আসেন। আসলে এটি ছিল মহা বিরক্তিকর অবস্থা। না পারি সইতে, পারিনা কইতে…. টাইপের অবস্থা।
ঘড়ি দেখলাম রাত সোয়া দশটা। শিলার গান শুনে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এবার ডিনারের পালা। একজন বলছে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে শিলাকে আনার দরকার কি ছিল? আরেকজন বলছে পাবলিক চাহিদা।
এক মহিলা বললো- সামিনা চৌধুরী আর কুমার বিশ্বজিৎই ছিলো এখানে সবচেয়ে মানানসই। আমি বললাম, একটা কনসার্টে যেখানে দশজন শিল্পী অথবা অনেকগুলো ব্যান্ড থাকে সেইখানে দুটি গান পরিবেশন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু একটা পুরো কনসার্ট চালিয়ে যাওয়ার জন্য সে এপ্রাপিয়েট নয়। কারণ তার গানে ভেরিয়েশনের বড়ই অভাব। সুকুমার রায়ের ছড়া দিয়ে গান তৈরি করতে পারা অনেক সাহসের ব্যাপার কিন্তু এরপর মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হচ্ছে। পারফর্ম্যান্স বাদ দিলেও, শিলার মাঝে আমি কোন স্পিরিচুয়াল ব্যাপারও খুঁজে পেলাম না। যা পেলাম তা হচ্ছে, একরাশ বাচালতা আর ঔদ্ধত্ব। কাহ্লিল জিব্রানের ভাষায়- তার চাইতে মৌনতা অনেক ভালো। আসলে শুধু চিৎকার আর কিছু মিশ্র সঙ্গীতের ঝনঝনানি দিয়ে কি দর্শকদের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করা সম্ভব?
চমক, গিমিক কতক্ষণ ভালো লাগে? আমার মনে হচ্ছে রুপসী বাংলার উইন্টার-গার্ডেন হলে সোল মিউজিকটাই ছিল এপ্রোপিয়েট। ধরুণ যে কেউ গান করছে, পিয়ানো বাদক বাজাচ্ছে সব ধরনের স্টাইলকে মিশিয়ে, কখনও তিনি ব্লুজ স্টাইলে অল্প কিছু নোট বাজাচ্ছেন, তারপর ধীরে ধীরে সুন্দর কিছু হারমোনি, তারপর আরো ধীরে ধীরে কিছু ফ্যাট কর্ড, গিটারিস্ট বাজাবে অসম্ভব অনুভূতি দিয়ে অল্প কিছু নোট।
পাশে থাকবে আরো কয়েকজন নারী সহ-শিল্পী। যারা শুধু হারমোনাইজ করবে না, অনেক সময় তারা আত্মা দিয়ে এমন কিছু গাইবে যা পূর্ব পরিকল্পনার বাইরে। আর বেইজ বাদক আর ড্রাম বাদক পুরো অনুষ্ঠানের পাল্সটাকে ধরে রাখবে। এভাবে সুরের তালের মুচ্ছূনায় সবার আত্মা এক হতে বাধ্য।
প্রথমে দর্শকদের পাল্স বুঝতে হবে। আর যারা যন্ত্র বাজাবে, তারা যে কোন সময় যে কোন কিছু বাজানোর যোগ্যতা রাখবে। মানে তাদের ব্রেইনে সব ধরনের মিউজিক সম্বন্ধে আইডিয়া থাকতে হবে। আর দিন শেষে তারা পরিবেশন করবে ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’।
একদিন ওশোর কাছে তার এক শিষ্য প্রশ্ন করলো, গুরু আমি কীভাবে একজন বড় শিল্পী হবো? ওশো বলল, তুমি আগে ছবি আঁকার সব কলাকৌশল রপ্ত কর। এবার সব ভুলে যাও। এখন তুমি যখন ছবি আঁকতে বসবে তখন কলাকৌশলগুলো আপনা আপনিই চলে আসবে। আসলে আধুনিক মিউজিকের ব্যাপারটা পুরোপুরি সেরকম।
জানতে হবে, বুঝতে হবে বাখ্ থেকে শোঁপা, স্কট জপ্লিন, বিল ইভান্স, কিথ্ জ্যারেট কিন্তু আপনি বাজাবেন নিজের মতন করে কিছু একটা এবং এটাই হচ্ছে লাইভ মিউজিক। (চলবে)