শ্রদ্ধেয় মনীষী ও ইতিহাসবিদ শ্রী অমলেশ ত্রিপার্টি তাঁর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭) গ্রন্থে ভূমিকার শুরুতেই লিখেছেন ‘একটা বৃহৎ প্রেক্ষাপটে অনেক ঘটনার সঙ্গে অন্বয়ের বা দ্বন্দ্বের ফলে তার ঐতিহাসিক মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে।’ এই আলোকে আমি শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং কলকাতা শহরের ইতিহাস ও অবস্থান, অন্ধি সন্ধি, অলি-গলি, প্রাচীন বসবাস এবং ঊনিশ শতকের কলকাতার শহুরে জীবিকা ও জীবনচর্চা, তার নানাবিধ কার্যক্রমের অন্যতম সফল একজন লেখক এবং ইতিহাসকার রাধারমণ মিত্রের তথ্য প্রদান ও যুক্তির সঙ্গে শ্রদ্ধেয় বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা’ শব্দের ব্যূৎপত্তি নিয়ে আলোচনাটি অনেকটাই আজ অমীমাংসিত ও পরবর্তী সময়ে অনালোচিতই রয়ে গেছে।
রাধারমণ মিত্র একজন সার্থক বিশ্লেষক ও অনুসন্ধানকারী হিসেবে তাঁর ‘কলিকাতা’ শব্দের উৎপত্তির বিষয়টুকু বিভিন্ন তথ্যের সহযোগে মতামত প্রদান করেন। এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহাসিক প্রগতির সোপানে সত্যানুসন্ধানের অন্যতম লক্ষণ। আর এটি না করে যদি একজন ইতিহাসবিদ বা লেখক কিছু গর্হিত বাক্য প্রয়োগ করেন তবে আজকের আধুনিক ইতিহাস সংরক্ষণের বিধি, ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা, আলোচনা, অন্বয় ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে খুবই অশোভন বলে মনে হয়। এই আচরণের ফলে ভবিষ্যতে অনেক বিষয়ে অনেকজনের কাজের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে এবং তথ্য যাচাই বাছাইয়ের বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায় কারণ সত্য একটি সংবাদের, তথ্যের প্রতি উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুরুত্ব প্রদানে অনীহা প্রকাশ ও অসম্মান প্রদর্শন তার আন্তরিক শ্রমলব্ধ কাজেরও অবমূল্যায়ন হয়।
অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে যে অনেকজনই অনেক কাজের সঙ্গেই মোহাবিষ্ট হয়ে সামিল হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও পারঙ্গমতা (শ্রম ও জ্ঞান) নিয়েই এগিয়ে যান কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুবই বেদনার সঙ্গে পরিলক্ষিত হয় যে তিনি একটি পরিত্যক্ত হল্ট স্টেশনের থার্ড লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন আর তার সম্মুখে একটি অকেজো সিগন্যাল হাউজ। এই দৃশ্যতো একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কাম্য হতে পারে না। বড়ো দুঃখের, বড়ো কষ্টের যখন দেখি কিছু গাইডবুক সর্বস্ব জীব দুঃসাহসবশত কিছু আবর্জনা টেনে একটি সুন্দর প্রাচীন বৃক্ষের গোড়ায় পরিচর্যার নামে প্রয়োগ করেন। অথচ তাদের টিকিটিরও কোনো দিন দেখা মেলে না! একটি চারাগাছ রোপণের আয়োজনে।
এই ধরনের মনোবৃত্তি সম্পন্ন কিছু ক্রিয়াকলাপ যেকোনো উপাদান বা সূত্র অন্বেষণে অন্যতম প্রতিবন্ধক। প্রসঙ্গত বলা যায় শ্রদ্ধেয় রাধারমণ মিত্রের ‘কলিকাতা দর্পণ’র কলিকাতা শব্দের বূৎপত্তির বিষয়ে শ্রদ্ধেয় ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলাসাহিত্যের সাধক ও গবেষক সুকুমার সেন এবং লোক সংস্কৃতির গবেষক তারাপদ সাঁতরা’র শিক্ষণীয় মতামতের কথা এবং প্রত্যুত্তরে শ্রদ্ধেয় রাধারমণ মিত্রের রচনাগুলি। যাঁরা ‘কলিকাতা দর্পণ’র দ্বিতীয় খণ্ডের এই ইতিহাস ও শব্দের বূৎপত্তি বিষয়ক চিঠিগুলো পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে শব্দের বূৎপত্তিগত বিষয়ে একটা বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী শব্দ বিজ্ঞান ও তার উচ্চারণগত দিক সর্বোপরি স্থান, পরিবেশ, জীবনচর্চার ইতিহাস এমনকি দার্শনিক ভিত্তির দিকেও (Nomional, Conceptual & real) গভীর নজর দিতে হয়।
একটি শব্দের বূৎপত্তি ও বিস্তৃতির ক্ষেত্রে আমার মনে হয় একটি মানুষের নামাকরণ, বিস্তৃতির মতোই তার উপকরণগুলো কাজ করে। মানুষের নাম, পরিচিতি, জীবনের যাবতীয় সঠিক আত্মসমীক্ষণই বোধ হয় যেকোনো শব্দের সঠিক অর্থ উদ্্ঘাটনের উপায়। হয়তো মানুষের নৈর্ব্যক্তিক সমীক্ষণের ওপরই নির্ভর করে মানুষের, ইতিহাসের কাজ-অকাজ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।