বিবস্ত্র করে মারধর, কুকুরের মতো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, ছাদের সঙ্গে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, শ্বাসরোধ করতে নাকে-মুখে পানি ঢালা, জোর করে খাওয়ানোর মতো আরও ভয়ংকর যে সব নির্যাতন চলত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র বন্দিশিবিরে সে সবেরই বিস্তারিত বর্ণনা এই প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন সাবেক আল কায়দা সদস্য ও গুয়ান্তানামো বে কারাগারের বন্দি মজিদ খান। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল বৃহস্পতিবার গুয়ান্তানামোয় মার্কিন ঘাঁটির সামরিক আদালতে হাজির হয়ে মজিদ খান ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার ওপর চলা সিআইএ’র নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। সেই কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে। সন্ত্রাসের সন্দেহে আটকদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া এবং স্বীকারোক্তি আদায় করতে সিআইএ’র ‘ব্ল্যাক সাইট’ হিসাবে পরিচিত গোপন বন্দিশিবিরগুলোতে যাকে বলা হয় জিজ্ঞাসাবাদের বাড়তি কৌশল, বাইরে সেটিই ব্যাপকভাবে বন্দি নির্যাতন হিসাবে নিন্দিত।
সিআইএ’র সেই কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলের মুখে পড়ে দিনের পর দিন কতটা যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা নিয়েই আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪১ বছর বয়স্ক মজিদ খান। যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের সাবেক এই বাসিন্দা পরবর্তীতে হয়েছিলেন জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদার দূত। টুইন টাওয়ারে ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পর মজিদ সিআইএ’র জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন।
সাবেক এই আল-কায়েদা সদস্য তার বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাস, ও খুনসহ আরও কিছু অভিযোগ স্বীকার করেছেন। শুনানি শেষে শুক্রবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে সামরিক আদালতের। রায়ে তার ২৫ থেকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। বৃহস্পতিবার আদালতে জুরিদের সামনে শুনানিতে মজিদ বলেছেন, ২০০৩ সালে পাকিস্তান থেকে আটক হন তিনি। এরপর তাকে তুলে দেওয়া হয় সিআইএ’র হাতে। তিনি সিআইএ-কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। আশা ছিল মুক্তি মিলবে। কিন্তু মজিদ বলেন, যতই তিনি সহায়তা করেছেন, ততই বেড়েছে নির্যাতনের মাত্রা।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মজিদ বলেছেন, মনে হতো আমি মারা যাচ্ছি। তিনি জানান, ছাদের সঙ্গে তাকে হাত বেঁধে দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখা হত। লম্বা সময় ধরে ঘুমাতেও দেওয়া হতো না। জাগিয়ে রাখতে দিনের পর দিন ঢালা হত বরফ পানি। মাথা ঠেসে ধরে রাখা হত পানির নিচে। পানি থেকে ওপরে তোলা মাত্র নাকে-মুখে আবার ঢালা হত পানি। এমনকী হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে নেওয়ার সময় তার মাথায় দেয়াল, সিঁড়ি ও মেঝের আঘাত লাগত। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না।
মজিদ যেভাবে জড়ান আল-কায়েদায় : মজিদ খান বলেছেন, তার জন্ম সৌদি আরবে। ৮ ভাই, বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। শৈশব কেটেছে পাকিস্তানে। ১৬ বছর বয়সের সপরিবারে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। মজিদ পড়াশোনা করেছেন বাল্টিমোরের একটি স্কুলে। পরে চাকরিজীবন শুরু করেন একটি মার্কিন টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার সময় সেই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের টেলিফোন ব্যবস্থা দেখভাল করত।
মজিদ জানান, ২০০১ সালের শুরুর দিকে তার মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর তার জীবনধারা ভিন্ন মোড় নেয়। ২০০২ সালে একটি পারিবারিক ভ্রমণে পাকিস্তানে যান মজিদ। সেখানে তার বিয়ে হয়। দেখা হয় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে অনেকেই আগে থেকে যোগ দিয়েছিলেন আফগান যুদ্ধে। যোগাযোগ ছিল আল-কায়েদার সঙ্গেও। তারাই মজিদকে আল কায়দায় ভিড়তে চাপ দেন। মজিদের কথায়, আমি স্বেচ্ছায় আল-কায়েদায় যোগ দিয়েছিলাম। আমি বোকা ছিলাম, অনেক বোকা। তারা আমকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া এবং পাপ শুদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আমি তাদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম।
সিআইএ’র কাছে মজিদের স্বীকারোক্তি : ২০১২ সালে সন্ত্রাসের অভিযোগে দোষ স্বীকার করেন মজিদ খান। সেইসঙ্গে যুদ্ধআইন ভেঙে খুন করা, ২০০৩ সালের শুরুর দিকে আল-কায়েদার একটি শাখার কাছে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার সরবরাহ করার অভিযোগও তিনি স্বীকার করেছেন। ওই অর্থ ২০০৩ সালের আগস্টে ম্যারিয়ট হোটেলে বোমা হামলায় ব্যবহার হয়েছিল।
২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত থাকার কথাও সিআইএ’র জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন মজিদ। তবে ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। পারভেজ মোশাররফকে হত্যা পরিকল্পনায় মজিদ কাজ করেছিলেন খালিদ শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে। ৯/১১ হামলার হোতা মনে করা হয় এই খালিদ শেখকে। খালিদের সঙ্গে আরও নানা অপরাধের পরিকল্পনা করার কথাও স্বীকার করেছেন মজিদ। এতসব অভিযোগে মজিদের দীর্ঘ ২৫ থেকে ৪০ বছরের সাজা ঘোষণা হওয়ার কথা থাকলেও তাকে খুব বেশিদিন সাজা ভোগ করতে হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।











