দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিং লিমিটেড সমপ্রতি এ নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে দ্য ল্যানসেট এ প্রকাশিত ‘ই ক্লিনিক্যাল মেডিসিন নামক ওপেন-এঙেস পিয়ার রিভিউড জার্নালে। এই গবেষণায় এসেছে সামগ্রিকভাবে কিশোর বয়সের মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা সমবয়সি ছেলেদের চাইতে বেশি। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর আর ১১ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী।
গত ২৬ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একই পাতায় পাশাপাশি। একটি ‘কাপড় কেনার টাকা দিতে দেরি, স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা’ এবং অন্যটি ‘মোবাইল ভেঙে ফেলায় অভিমানে আত্মঘাতী কিশোরী’। প্রথম সংবাদে বলা হয়েছে, তিন দিন পূর্বে এক প্রতিবেশী থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে নতুন কাপড় ক্রয় করে রিয়া। রোববার রাতে তার পিতা বাড়িতে আসলে ধার করে নতুন কাপড় কেনার বিষয়টি জানায়। ধারের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য পিতার কাছ থেকে টাকা খোঁজে। কয়েকদিন পর ধার করা টাকা ফেরত দিবে বলে মেয়েকে আশ্বাস দেন পিতা। কিন্তু কাপড় কেনার টাকা দিতে দেরী হওয়ায় পিতার সাথে অভিমান করে আত্মহত্যা করে স্কুল ছাত্রী রিয়া। দ্বিতীয় সংবাদে বলা হয়েছে, বয়ফ্রেন্ডের দেওয়া মোবাইল ভেঙে ফেলায় বাবার সাথে অভিমান করে বাকলিয়ায় শাহনাজ আকতার অভি (১৩) নামের এক কিশোরী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাকলিয়া থানার এস আই দৈনিক আজাদীকে বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় বয়ফ্রেন্ডের দেওয়া মোবাইলে তার সাথে কথা বলতে দেখে অভির বাবা মোবাইলটি নিয়ে ভেঙে ফেলেন। এতে অভিমান করে বাসার কক্ষের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সাথে ঝুলে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে আনুমানিক ১২-১৪ বছর বয়সী এই কিশোরী।
দুটি সংবাদেই দুই কিশোরীর অভিমানের কথা ব্যক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে জানা যায় যে, দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশে আত্মহত্যার সঠিক হার নির্ণয় না করা গেলেও গবেষণায় দেখা যায়, কিশোর-কিশোরী এবং কমবয়সি তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। সামপ্রতিক সময়ে গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অন্তত প্রতি ১০ জনে একজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে। এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যাকে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পূর্বাভাস কৈশোরেই পাওয়া যায়। সেটা সম্ভব হয় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা আছে কি না তা বোঝার মাধ্যমে। তাঁরা বলছেন, আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা এবং চেষ্টা- এ তিনটি বিষয়ের কোনও একটি যদি কারও মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার আত্মহত্যা প্রবণতা আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
গবেষণা জানাচ্ছে, বিশ্বে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের প্রতি ৬ জনে অন্তত একজনের মাঝে এই তিনটি বিষয়ের যে কোনও একটি আছে। কৈশোরে আত্মহত্যা প্রবণতা থাকা যেমন ভবিষ্যতে আত্মহত্যা করাকে ইঙ্গিত করতে পারে; তেমনি এটি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। আবার বিভিন্ন মানসিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাও একজনের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ছেলেদের আত্মহত্যার হার বেশি। কিন্তু মধ্যম আয় আর নিম্ন আয়ের দেশে এই হার সমান-সমান বলেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে অবহেলা, অপমান, কটূক্তি, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, সহিংসতা ও প্রতিযোগিতামূলক তুলনা, এসব নানা কারণে শিশু-কিশোররা হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। বলতে গেলে উল্টো কটু কথা শুনতে হয়। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুর কথা চিন্তা করে থাকে তারা। একসময় তারা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাবা-মা, ভাই-বোন বা পরিবারের সদস্যদের উচিত, কাউকে অবহেলা না করা। পারিবারিক সহিংসতা বা ঝগড়া-বিবাদ ছোটদের সামনে না করা। সন্তানদের কথা শুনতে হবে, তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত নিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।