রোম সম্রাটের দরবারে নবী পাক (স.)’র মেরাজের মুজেযার বাস্তবতার প্রকাশ
মহান রবিউল আউয়াল মাস। এই মাস আসলে নবী পাক (স.)’র শানে কলম ধরতে মন থেকে তাড়িত হই। নবী পাক (স.) মসজিদুল হারম থেকে মসজিদে আকসা হয়ে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে মেরাজে গমন করেছিলেন। এ ঘটনা ঐ সময় বিধর্মীরা মেনে নিচ্ছিল না। এমনিতে আল্লাহর রাসূল (স.)’র একত্ববাদ প্রকাশে তাঁর কুরাইশ বংশের নেতাগণ শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৩তম সনে নবী পাক (স.) মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন। ৬ষ্ঠ হিজরিতে ওমরাহ্ করতে এসে হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়। বিধর্মীদের সাথে সমঝোতা হয় লিখিত চুক্তি তথা সন্ধির মাধ্যমে। এরপর থেকে বিভিন্ন রাজা বাদশাহ গোত্র প্রধানগণের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। তেমনিভাবে নবী পাক (স.) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে পত্র লিখেন। সে সময় তিনি জেরুজালেমে ছিলেন। পত্র বাহক মহান সাহাবা দাহিয়া ইবনে কালবী (র.) জেরুজালেম পৌঁছেন।
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। সম্রাট নবী পাক (স.)’র পত্র পেয়ে বিস্তারিত জানলেন। অতঃপর অবস্থা জানার জন্য আরবের কিছুসংখ্যক লোককে সমবেত করতে চাইলেন। যেহেতু হেজাজ অঞ্চল থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে আরবীয়গণ জেরুজালেমে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। ঐ সময় আবু সুফিয়ানসহ একটি বাণিজ্যিক কাফেলা জেরুজালেম গমন করেছিলেন। সম্রাটের নির্দেশে তাদেরকে দরবারে উপস্থিত করা হয়। সম্রাট তাদেরকে যেসব প্রশ্ন করে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ সহীহ বুখারী, মুসলিমসহ প্রভৃতি গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। আবু সুফিয়ানের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, সে সুযোগে নবী পাক (স.) সম্পর্কে এমন কিছু কথাবার্তা বলবে যাতে সম্রাটের সামনে নবী পাক (স.)’র ভাবমূর্তি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়।
আবু সুফিয়ান নিজেই বলে যে, আমার এ ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করার পথে একটি মাত্র অন্তরায় ছিল। তা এই যে, আমার মুখ দিয়ে কোন সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা বেরিয়ে পড়লে সম্রাটের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন এবং আমার সঙ্গীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে ভর্ৎসনা করবে। তখন আমার মনে মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করার ইচ্ছা জাগে, এটা যে মিথ্যা ঘটনা সম্রাট তা নিজেই বুঝে নেবেন। আমি বললাম; আমি তার ব্যাপারটি আপনার কাছে বর্ণনা করছি, আপনি নিজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এতে স্বভাবকই সম্রাট কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটি জানতে চায়। এতে আবু সুফিয়ান বলল; নবুওয়্যাতের এ দাবিদারের উক্তি এই যে, সে এক রাত্রিতে মক্কা মোকাররমা থেকে বের হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রত্যুষের পূর্বে মক্কায় (মোকাররমা) আমাদের কাছে ফিরে গেছে।
আবু সুফিয়ান বলল, আমার কথা শ্রবণ করতেই বায়তুল মোকাদ্দাসের লাট পদবী বলে উঠলেন তা সম্পূর্ণ সত্য। এ লাট হলেন প্রধান যাজক ও পন্ডিত। তিনি সে সময় রোম সম্রাটের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্রাট জানতে চাইলেন আপনি তা কিভাবে জানেন? তিনি বললেন আমি মসজিদের দরজাসমূহ বন্ধ না করে ঘুমাতে যাই না। সেই রাত্রে একটি দরজা বাদে সকল দরজা আমি বন্ধ করে দিই। কিন্তু ঐ দরজাটি আমি কোন মতেই বন্ধ করতে সক্ষম হলাম না। তখন আমি আমার অন্যান্য কর্মচারী ও উপস্থিত লোকদের সাহায্য চাই। সকলে জোর খাটিয়ে দরজাকে সন্তান থেকে সরাতে পারলাম না। যেন কোন পাহাড় সরাচ্ছি মনে হল। আমি কাঠ মিস্ত্রি ডাকলাম; তারাও তা লক্ষ্য করে দেখে চেষ্টা করল। কিন্তু কোন উপায়েই দরজা সরাতে সক্ষম হল না। এতে সকাল পর্যন্ত দরজা বন্ধ করার কাজ স্থগিত রাখা হল।
পাদরী বলেন, আমি দরজাটি খোলা রেখে দিলাম। ভোরে যখন দরজার কাছে আসলাম তখন মসজিদের পাশে পড়ে থাকা পাথরটিতে ছিদ্র দেখলাম এবং তাতে কোন পশু বাধার চিহ্ন দেখতে পেলাম। তখন আমি আমার সাথীদের বললাম, আজ রাতই কোন নবীর আগমনের জন্য দরজাটি খোলা রাখা হয়েছে কিনা? অবশ্যই এ মসজিদে তিনি সালাত আদায় করেছিলেন। বিষয়টি তাফসীরে ইবনে কাসিরে বর্ণনা রয়েছে। ইবনে কাসীর থেকে তাফসীরে মা’রেফুল কোরআনেও উদ্বৃতি করা হয়। বস্তুত হযরত জিব্রাইল (আ.) বাহন বোরাকে করে নবী পাক (স.) কে পবিত্র মক্কা মসজিদুল হারম থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসের দরজার নিকট নিয়ে আসেন। আঙ্গুলের ইশারায় তথায় রক্ষিত পাথর ছিদ্র করে ওখানে বোরাক বেঁধে রাখেন। নবী পাক (স.) সমস্ত নবী রাসূলগণকে নিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে দু’রাকাত নামাজের ইমামতি করেন। অতঃপর মহান আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
নবী পাক (স.) বিষয়ে জানতে কৌতূহলী হয়ে আবু সুফিয়ানের প্রতি প্রশ্ন এবং আবু সুফিয়ানের উত্তর:-
সম্রাট সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, যিনি নবী বলে দাবী করছেন তাঁর বংশ কেমন?
আবু সুফিয়ান : তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশগত।
সম্রাট : তাঁর পূর্বে তোমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি কখনও এমন কথা বলেছে কি?
আবু সুফিয়ান : না।
সম্রাট : তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিলেন কি?
আবু সুফিয়ান : না।
সম্রাট : প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা?
আবু সুফিয়ান : দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকগুলো।
সম্রাট : তাদের সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
আবু সুফিয়ান : না, বরং বাড়ছে।
সম্রাট : তাদের মধ্যে কেউ কি সেই দ্বীনে প্রবেশ করার পর তাঁর দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তা ত্যাগ করে থাকে?
আবু সুফিয়ান : না।
সম্রাট : সে নবুয়ত লাভের পূর্বে কি তোমরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে?
আবু সুফিয়ান : না।
সম্রাট : তিনি কখনো কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন কি?
আবু সুফিয়ান : না। তবে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁর সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, জানি না এ সময়ের মধ্যে তিনি কি করবেন?
আবু সুফিয়ান (পরবর্তীতে) বলেন, এই কথাটি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সম্রাট : তোমরা কি তাঁর সাথে কোন যুদ্ধ করেছ?
আবু সুফিয়ান : হ্যাঁ।
সম্রাট : যুদ্ধের ফলাফল কি?
আবু সুফিয়ান : তাঁর ও আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলাফল হল বালতিতে পালাক্রমে পানি তোলার ন্যায়। অর্থাৎ কোনটায় তিনি জয় লাভ করেন এবং কোনটায় আমরা।
সম্রাট : তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ দিয়ে থাকেন?
আবু সুফিয়ান : তিনি বলেন, তোমরা একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক কর না। আর তোমরা তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে বেড়াত, তা পরিত্যাগ কর। তিনি আমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করতে, সর্বদা সত্য কথা বলতে, অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকতে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে বলেন।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস দোভাষীর মাধ্যমে বললেন, তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে তিনি অত্যল্পকালের মধ্যেই আমার এ পদদ্বয়ের নিম্নবর্তী স্থানের (সিরিয়ার) মালিক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে হবেন, একথা ভাবতে পারিনি। আমি যদি যথাযথভাবে তাঁর নিকট পৌঁছতে পারব বলে জানতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সর্ব প্রকার কষ্ট স্বীকার করতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম।
বস্তুতঃ রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস নবী পাক (স.) যে সত্য নবী এবং আখেরী নবী তা অনুধাবন করে। ঈমান আনতে উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্য হারানোর ভয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে, কুট কৌশলে তা প্রত্যাহার করে নেন।
আহমদুল ইসলাম চৌধুরী : গবেষক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক