চৌধুরী হারুনর রশিদ : একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

চৌধুরী হারুনর রশিদ মুখ্যত রাজনীতিক, কিন্তু আরো বহুতর কর্মের প্রবর্তনা তাঁর জীবনকে বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের মহিমা দান করেছিলো। তিনি একাধারে রাজনীতিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, ভাষা সংগ্রামী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সংসদ সদস্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক ছিলেন।
অগ্নিযুগে, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার মনসা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আহমেদুর রহমান চৌধুরী। পিতামহ আশরাফ আলী। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামে, মাধ্যমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলে। তাঁর বড় ভাই আশু চৌধুরী ছিলেন রেল কর্মচারী। তিনিই পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলে ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈন্যরা চট্টগ্রামে বোমা হামলা শুরু করলে চৌধুরী হারুনকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে পার্শ্ববর্তী সেখানে ইউনিয়নের হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
পটিয়ার অপর নাম বিপ্লবতীর্থ। পটিয়ার মৃত্তিকার গভীরে বয়ে যায় বিপ্লবী চেতনার ফল্গুধারা। শহীদ বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কৃষ্ণ চৌধুরী, প্রমোদ চৌধুরী ও অর্ধেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু দস্তিদার, শরদিন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী ব্রজেন সেন ও কিরণ সেনের জন্মধন্য জনপদ পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করে চৌধুরী হারুনের প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়াই ছিলো স্বাভাবিক। তাঁর জন্মের চার বছর পর মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী শিষ্যরা ব্রিটিশের অস্ত্রাগার আক্রমণ ও দখলের পর চট্টগ্রামকে চারদিনের জন্য স্বাধীন করে ফেলেছিলেন। ছয় বছর পর প্রীতিলতা পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে আত্মাহুতি দেন। আট বছর পর বিচারের প্রহসন করে ব্রিটিশ সরকার মাস্টারদা ও তারকেশ্বরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। এই বিপ্লবী আবহে বেড়ে ওঠা চৌধুরী হারুন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম ছাত্রলীগে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে রুষ্ট হয়ে অচিরেই ছাত্রলীগের সংস্রব ত্যাগ করেন।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হলে ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেহনতী শ্রমিকদের আন্দোলন-সংগঠনের কাজে অধিকতর সম্পৃক্ত হন এবং ‘সাপ্তাহিক আওয়াজ’ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। এখানে আমরা সাংবাদিক চৌধুরী হারুনের সাক্ষাৎ পাই। তিনি প্রভাত নামে একটি পত্রিকায় ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতেন।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চৌধুরী হারুন রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস এমপ্লয়ীজ লীগের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছরে তিনি এ দেশে ব্যাংক কর্মচারীদের প্রথম সংগঠন ‘পূর্ব বাংলা ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়নে’র প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নির্বাচিত হন।
জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় চৌধুরী হারুন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ব্যয় করেছেন। ন্যাপের সহযোগি ও কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জনক তিনি। দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্তের ভারতবিখ্যাত বিওসি ও বুলক ব্রাদার্স শ্রমিক ধর্মঘট এবং চাঁদপুরে আসামের চা বাগান শ্রমিকদের আন্দোলন চট্টগ্রামে শ্রমিক রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ত্রিশের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পর পার্টির নেতা-কর্মীরা শ্রমিক আন্দোলন আরম্ভ করেন। ত্রিশের অন্তিমকালে দু’একজন ছাড়া চট্টগ্রামের প্রায় সকল বিপ্লবী মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে বিভিন্ন জেল ও আন্দামান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলে শ্রমিক রাজনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। কিন্তু সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পর কমিউনিস্ট পার্টিতে রণদীভে লাইন অনুসৃত হওয়ায় কমিউনিস্টরা ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের বিরোধিতা শুরু করলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।
চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরীর (ফ কা চৌ) প্রবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পীড়নে পিষ্ট হতে হতে মানবতা, মঙ্গলচিন্তা, কল্যাণাকাঙ্ক্ষা, শুভবোধ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ সময় শ্রমিক রাজনীতিতে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী ও কমিউনিজমে নবদীক্ষিত চৌধুরী হারুনর রশিদ।
চৌধুরী হারুন বুদ্ধিজীবী গোছের রাজনীতিক ছিলেন। পঞ্চাশের দশক চট্টগ্রামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চৌধুরী হারুন শ্রমিক রাজনীতির পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাও অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর চরিত্রে রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ঝোঁক ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ উৎপন্ন করলেও রাজনীতির স্রোতধারাই প্রবল হয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় রাজনীতির অঙ্গনে। ফলে চট্টগ্রাম একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হলো।
দেশভাগের পর কলকাতা থেকে কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক ঢাকা না গিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁরা হচ্ছেন শওকত ওসমান, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, এবনে গোলাম নবী, কলিম শরাফী, কবি মতিউল ইসলাম, রুস্তম খান, অধ্যাপক রফিউদ্দিন আহমদ ও তাঁর স্ত্রী নুরুন্নাহার, শেখ আলিমউদ্দিন, ওস্তাদ ফজলুল হক, আবদুল জলিল, রোকেয়া রহমান কবীর, ফরিদা হাসান, হাসনা বানু ও কামেলা শরাফী। কলকাতা থেকে এসব শিল্পী-সাহিত্যিকগণের আগমনে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। অবশ্য চল্লিশের দশকেই চট্টগ্রামে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ প্রতিষ্ঠার পর প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার সূত্রপাত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ‘সীমান্ত’ পত্রিকা প্রকাশ করে পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতার মূলে কুঠারাঘাত করেন। সীমান্ত উভয় বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যের আত্মবিকাশের বাহন হয়ে ওঠে। “এই সময় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মাহবুব উল আলম, রমেশ শীল, আবুল ফজল, ওহীদুল আলম, আশুতোষ চৌধুরী, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, গোপাল বিশ্বাস, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শুভাশীষ চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, মাহবুব হাসান, দেবপ্রিয় বড়ুয়া, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, ননী সেনগুপ্ত, বঙ্কিম সেন, কবি আবদুস সালাম, কবি সুধাংশ সরকার, শঙঘমিত্র মুৎসুদ্দী প্রমুখ শিল্পী-সাহিত্যিক তারার দীপ্তি নিয়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যকাশে জ্বলজ্বল করছিলেন।
সরকারি নির্যাতনে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ বন্ধ হয়ে গেলে সীমান্তই হয়ে ওঠে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার অবলম্বন। সীমান্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি বৈঠক।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা প্রতিষ্ঠা করেন প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। নামে নাট্য সংঘ হলেও সংস্কৃতির সামগ্রিক অনুশীলনের জন্যই গঠন করা হয়েছিলো এই নতুন সংগঠন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ মার্চ হরিখোলা মাঠে (বর্তমান মোমিন রোডের মৈত্রী ভবন) অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে জেএমসেন হলে অনুষ্ঠিত হয় লোক সংস্কৃতি সম্মেলন।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ এপ্রিল ঢাকায় কার্জন হলে ব্যাপক আকারে পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক শিল্পী সাহিত্যিকের দল উক্ত সম্মলেন যোগদান করে।
উপর্যুক্ত সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন চৌধুরী হারুন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরীর সঙ্গে ছিলো তাঁর গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি হরিখোলা মাঠের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের অফিস সম্পাদক ছিলেন।
৪৬-এর পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আবার উপমহাদেশে জুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিলো মানবতা। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি ও সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে চৌধুরী হারুনসহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছিলেন। সঙ্গীতজ্ঞ গোপাল বিশ্বাস চট্টগ্রামের শিল্পী-সাহিত্যকদের দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকার বর্ণনা দিতে যেয়ে লিখেছেন,
“এমনি ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার বিভীষিকার মধ্যে, চট্টগ্রাম শহরের পথে পথে একটি আশ্চর্য দৃশ্য জনসাধারণ দেখতে পেলো। শহরের পথ পরিক্রমা করছিলো-চট্টগ্রামের পরম শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ, সঙ্গীত শিল্পী, অধ্যাপক, কলেজ এবং বিদ্যালয়ের সর্বস্তরের ছাত্র সাধারণ। উচ্চ গলায় স্লোগান আউড়ে পথঘাট মুখরিত করে তুলছিল-‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’ এ যেন চট্টগ্রামবাসীর জাগ্রত বিবেক। এমনি এই অসাধারণ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন-সাহিত্যিক-অধ্যাপক আবুল ফজল, শওকত ওসমান, কবি ওহীদুল আলম, ‘সীমান্ত’ সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশীদ প্রমুখ। দাঙ্গার বিরুদ্ধে এমনি সোচ্চার ঘোষণার আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সীমান্ত’ পত্রিকার দাঙ্গা বিরোধী সংখ্যা। কবিতায়, প্রাবন্ধিক বক্তব্যে উচ্চারিত হলো-হিন্দু-মুসলমান জনসাধাণের ভ্রাতৃত্ব এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির জয়গান, ব্যক্ত হলো সুস্থ বিবেকবোধ এবং মানবিকতা। আর দাঙ্গার উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা।”
পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন : প্রেক্ষাপট চট্টগ্রাম : গোপাল বিশ্বাস, পৃ.২৪ (চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, প্রগতিশীল ধারা : মাহবুব হাসান), চট্টগ্রাম।
চৌধুরী হারুন চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে চৌধুরী হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে ভারপ্রাপ্ত আহবায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি বর্ষণের সংবাদ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছলে শ্রমিকদের নিয়ে প্রথম বিক্ষোভ মিছিল বের করে চৌধুরী হারুন। ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে অসুস্থ মাহবুব উল আলম চৌধুরী ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর শুনে আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলেন। সেই কবিতার নাম ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। মাহবুব উল আলম চৌধুরী কবিতাটি খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে দেন। ইলিয়াস পরদিন গোপনে কবিতাটি ছাপাতে নিয়ে যান কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে। প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী কবিতাটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে জনসভায় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতাটি পাঠ করার কথা। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় চৌধুরী হারুনর রশিদ সেদিন লালদিঘি ময়দানে কবিতাটি পাঠ করেছিলেন।
এরপর চৌধুরী হারুনের ওপর হুলিয়া জারি হয়, কিছুদিন হুলিয়া এড়াতে সমর্থ হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তিনি ৪ বছর বিনা বিচারে জেলে আটক ছিলেন। কিন্তু জেলখানার ভেতরেও তিনি ছিলেন প্রতিবাদ-সংগ্রামে মুখর। কারাবন্দিদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চৌধুরী হারুন জেল থেকে মুক্তি পান এবং আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও চৌধুরী হারুনর রশীদ বেশি দিন আওয়ামী লীগে থাকেন নি। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যাপ গঠিত হলে তিনি ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আয়ুব খানের আমলে চৌধুরী হারুন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯-এ ১২ বছর হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনরত অবস্থায় ৬২ ও ৬৪’র ছাত্র আন্দোলন এবং সামরিক একনায়ক আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর প্রজ্ঞা, চাতুর্য ও দূরদর্শিতা দিয়ে অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোপন অবস্থান পাল্টে পাল্টে নেপথ্যে থেকে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে পরামর্শ ও প্রণোদনা প্রদান করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভূতপূর্ব সমর নৈপূণ্যের পরিচয় দেন। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা একজন সিভিলিয়ানের অসামান্য সামরিক প্রতিভার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হন। যুদ্ধকালে তাঁর ভারতে অবস্থানকালে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনাক্রমে মে মাস থেকে যৌথভাবে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য-কর্মীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ঐ কর্মসূচি অনুসারে নভেম্বর পর্যন্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে, তিনি ছিলেন তার অপারেশন কমান্ড কাউন্সিলের অন্যতম আহবায়ক। দেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময় চৌধুরী হারুনর রশীদ বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি ও সুখ্যাতি লাভ করেন।
১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশের শ্রমজীবী ও মেহনতী জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন-এর জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ অবস্থায় পটিয়ায় ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গণতান্ত্রিক দলে যোগদান করেন এবং ঐ দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিমন্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য পদ লাভ করেন।
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী : লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধঐশী এখন চিকিৎসক