প্রতিমা বিসর্জনের দিন চট্টগ্রাম নগরীর জেএমসেন হলেও শুক্রবার জুমার নামাযের পর হামলার জোর চেষ্টা হয়। জের ধরে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় সন্ধ্যায়। ডাকা হয় শনিবারে অর্ধ দিবস হরতাল। এই হামলা প্রয়াস নগরবাসীর জন্য মারাত্মক একটি ক্ষতচিহ্ন। এমনিতেই প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণে জনজীবন বিপর্যস্ত। গ্রীষ্মের চে’ও অস্বাভাবিক তাপ প্রবাহের সাথে মধ্যরাতে ভয়ঙ্কর বজ্র মিশাইলে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা একেবারেই কাহিল। শরতের শেষলগ্নে এমন তীব্র তাপদাহ, বজ্র-বিদ্যুৎ স্মরণকালে সম্ভবত প্রথম। তাপদাহের সাথে পাল্টাপাল্টি তীব্র প্রতিযোগিতা দিয়েছে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সামপ্রদায়িক সহিংসতা। কুমিল্লায় অস্থায়ী দুর্গোৎসব আয়োজনে রাতের আঁধারে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অবমাননার ঘটনা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি নষ্ট রাজনীতিও এর সাথে জড়িত। কোন হিন্দু ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়ে নিজেদের আত্মহননের পথ বেছে নেবে, এটা কল্পনা করাও অসম্ভব। চলমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নমুনা সামনে রাখলে যে কারো কাছে তা পরিস্কার হয়ে যাবে। ধর্মীয় উম্মাদনায় বারুদ কে বা কারা আগুন দেবে, ধারণা নিতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। আশ্চর্য, ঘটনার জের ধরে দেশের বহুস্থানে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। হামলা হয়েছে অসংখ্য মন্ডপ, মন্দিরে। এতে চরম নিরাপত্তাহীন সনাতনী সমপ্রদায়ের বড় উৎসবটি বিষাদের কালো পর্দায় ঢেকে দেয়।
আমাদের ধর্মীয় আলেম ও ওলামা কেরামদের এটা বোঝা উচিত, দেশের মাত্র ৯/১০ শতাংশ হিন্দু পবিত্র কোরআন শরীফকে এভাবে অবমাননা করার সাহস কখনো পারেনা। তারা চাইলে পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরতে পারতেন। পারতেন সরকারি দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূলের দায়িত্বশীল নেতারা। কিন্তু ব্যাতিক্রম ছাড়া তারা স্রোতে ভাসা শ্যাওলা। উল্টো বান্দরবানের লামায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি দলের কিছু নেতা হামলা ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। আলেম ওলামারাও পুজা বা মন্ডপে হিন্দু সমপ্রদায়ের পাশে দাঁড়ান নি। আবার বিসর্জনের দিনে বায়তুল মোকাররম থেকে জুমার নামাযশেষে প্রতিবাদী মিছিল বের করে দেশব্যাপী ভীতি ছড়িয়েছে একটি গোষ্ঠী।
আমরা বারবার ভুলে যাই, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম। মানুষকে অমর্যাদা-অসম্মান করে কোন ধর্ম পালন হতেই পারে না। হওয়া যায় না প্রকৃত ধার্মিক। মাতৃজঠরে একটা মানব শিশুর ভ্রণ সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ পাকের দান। তিনিতো হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃশ্চান বাছাই করে ভ্রণ মায়ের জরায়ুতে উপহার দেন না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শিশুটি যে ধর্মাবলম্বীর ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসে, জন্মসূত্রেই সে ঐ ধর্মের জাতক। অবোধ ও নিষ্পাপ শিশুরতো ধর্ম পালন বা বাছাইয়ের কোন সুযোগ নেই। পারিবারিক ধর্মের আবহে সে বড় হয়, ধারণ করে বাবা-মায়ের ধর্ম। তার জন্মের দায় তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার, তার নয়। তাহলে সৃষ্টিকর্তার সৃজন নিয়ে আমরা কেন সহিংসতার বারুদে আগুন দেই? এই সত্য না বুঝলে আমরা কীসের ধার্মিক! আমি মুসলিম হয়েছি, বাবা মা মুসলিম বলে। উনি হিন্দু বা বৌদ্ধ হয়েছেন, তার বাবা-মা হিন্দু বা বৌদ্ধ বলে। তাহলে দায়টা কার?
সবার জানা, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইষ্টচার্চে একজন উগ্র শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী জুমার নামাযে মসজিদে বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা করে অর্ধশত মুছল্লি। মাত্র ক’বছর আগের ঘটনা। ঘটনার পরপর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা এডার্ণ রাস্তায় নেমে এসে মুসলিমদের সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। হিজাব, নেকাব পরে পরবর্তী জুমার নামাযে অংশ নেন। সাথে নগরীর সব খৃশ্চানও। দোয়া-দরুদ পরে মুনাজাতে শরিক হন প্রকাশ্যে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি জানাতে দুপুরের লাঞ্চ পর্যন্ত বর্জন করেন তিনি । স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয়সহ মানবঘাতি সব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে দেন। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ সব ফোরামে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে সমর্থন দেন। সারা পৃথিবীর মুসলিম ও সর্ব ধর্মের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাঁর এমন দুঃসাহসী ও মানবিক দৃষ্টান্তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। ঘটনাটি বাদ দিলে নিউজিল্যান্ড এখনো পৃথিবীর সবচে’ শান্তির দেশ। নিউজিল্যান্ডের মুসলিমরা সঠিক ও শান্তিপূর্ণ ধর্ম পালনে পৃথিবীতে এখনো প্রথম। সৌদি আরবসহ মুসলিম উম্মাহর দেশগুলো অনেক পেছনে। পশ্চিম ইউরোপসহ আরও বহু উন্নত দেশেও তাই। ভাবুন এবার, আমরা কোথায়?
অস্বাস্থ্যকর ও অসুস্থ রাজনীতি দেশে ধর্মীয় বিভাজন আরও বাড়াচ্ছে। পৃথিবীতে কোন মানুষই সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু নয়। সবাই সমান, মানবিক বোধই মনুষ্যত্বের মাপকাঠি। আমাদের সংবিধানেও এটা স্বীকৃত। তাহলে রাষ্ট্র কেন এমন বিভাজনকে স্বীকৃতি দেবে? কেনইবা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃশ্চান ঐক্য পরিষদ? এসবতো মহল বিশেষের রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারের দাবার গুটি! অসুস্থ রাজনীতি এবং পরিশুদ্ধ ধর্ম পালন হচ্ছে না বলেই সামপ্রদায়িক উগ্রবাদ, সহিংসতা ও অস্থিরতার আবাদ বাড়ছে। রাজনীতি সুস্থ ও সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মানবিক বোধের পরিচর্যা ছাড়া ভয়াল এই সমস্যার সমাধানে কোন টোটকা চিকিৎসায় অসম্ভব। রাজনীতিতে পচন ধরলে দেশের অন্য কোন খাত সুস্থ থাকতে পারেইনা, সম্ভবও না। এখন তাই ঘটছে। মেধা-মননের পরিচর্যাহীন, জ্ঞানবিমুখ রাজনীতির বদ্ধ ডোবায় নেতা নয়, তৈরি হয় ছোটবড় অসংখ্য ভোগী-খাদক। সুযোগটা লুফে নেয়, অন্য সব সেক্টরে ওৎ পেতে থাকা ভাগ্য শিকারীর দল। দেশজুড়ে এরা হায়েনার মত বংশ বিস্তার করছে। যে যেভাবে পারে, দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে হাড়মজ্জা পর্যন্ত চুষে খাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ মানেই তাদের উল্লাসের গরম মশলা! মানুন বা নাই মানুন, আমরা একটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জাতির কানাগলিতে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি। উন্নয়ন চাকচিক্যের বার্ণিশের বাধ দিয়ে এই অধোগমন থামানো অসম্ভব।