সনদপত্রে নাম সংশোধনে এক যুবকের আবেদন ঘিরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের নাম-বয়স সংশোধনী সভায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে কমিটির অন্য সদস্যরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বিকেল ৫টার দিকে সভার শেষ পর্যায়ে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ধর্মান্তরিত ওই যুবকের নাম সংশোধনের আবেদনটি উত্থাপিত হলে সেটি নিয়ে সভায় আলোচনা-পর্যালোচনা চলে। এক পর্যায়ে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান ও আবেদনকারী যুবকের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এ সময়ে বোর্ডের কয়েকজন কর্মচারী ধস্তাধস্তি করে ওই যুবককে সভা কক্ষ থেকে বের করে আনেন। পরে আনসার সদস্য ডেকে ওই যুবককে বোর্ড থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে পাঁচলাইশ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-৫৪১) দায়ের করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের আদেশক্রমে শিক্ষাবোর্ডের সচিব এ জিডি করেছেন। নাম-বয়স সংশোধনী সভায় অপ্রীতিকর ঘটনা ও এর প্রেক্ষিতে থানায় জিডি করার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন শিক্ষাবোর্ডের সচিব প্রফেসর আব্দুল আলীম। পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবিরও জিডি হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওসি।
জিডিতে দাবি করা হয়েছে, আবেদনের সাথে দাখিলকৃত হলফনামায় তথ্যগত বিভ্রাট থাকায় হলফনামা সংশোধন করে দাখিলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আবেদনকারী বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কমিটির সদস্যদের দিকে আক্রমণাত্মকভাবে গালাগাল শুরু করেন এবং মারমুখী ভঙিমায় তেড়ে যান। এ অবস্থায় বোর্ডের সেকশন অফিসার আবু তাহের মো. নিজামী এবং আনসার সদস্য মো. ইব্রাহিম বাধা দিলে তাদের ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যান।
তবে আবেদনকারী যুবক দাবি করেছেন, অনলাইনে নাম সংশোধনের জন্য বোর্ডের উপ সচিব বেলাল হোসেন তার কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। সেই টাকা না দিয়ে তিনি ম্যানুয়ালি আবেদন করায় শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা তাকে হয়রানি শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার তার নাম সংশোধনের আবেদনটি মঞ্জুর না করে বিভিন্ন মানহানিকর মন্তব্য করা হয়। অথচ শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের পরামর্শ মেনেই কোর্টের এফিডেভিটসহ আবেদনটি জমা দেন তিনি। সভায় আবেদন মঞ্জুর না করার বিষয়ে প্রতিবাদ জানালে নিরাপত্তা কর্মী দিয়ে তাকে মারধর করা হয়। টেনে-হিঁচড়ে তাকে বের করে দেয়া হয়।
আবেদনকারী যুবকের নাম মান্দি ডি কস্টা। তিনি নগরীর হালিশহরের মেহের আফজল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। বর্তমানে তিনি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের ঢাকা অফিসে নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব প্রফেসর আব্দুল আলীম আজাদীকে বলেন, তার আবেদনটি পরবর্তী সভায় বিবেচনার জন্য রাখার কথা বলা হয়। ওই সময় আবেদনকারী যুবক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেন। অনেকটা মারমুখি আচরণ করেন। ছেলেটি আবেদন করলেও তার মা-বাবা এসে নাম সংশোধনের ওপর আপত্তি দিয়ে একটি কমপ্লেইন দিয়েছেন জানিয়ে বোর্ড সচিব বলেন, কমপ্লেইনে তারা বলেছেন ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। তার চিকিৎসা চলছে। তবে মা-বাবার এ ধরনের কমপ্লেইন গ্রহণ করার সুযোগ আমাদের নেই। তাছাড়া ছেলেটি যে মানসিক ভারসাম্যহীন সেটি তো প্রমাণ সাপেক্ষ। ওই যুবকের মা-বাবারাও সভার সময় এসেছিলেন।
তবে আবেদনকারী মান্দি ডি কস্টার দাবি, দেড়মাস আগে নাম সংশোধনের বিষয়ে উপসচিব বেলাল হোসেনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন। এসময় অনলাইনে আবেদনের কথা বলে ১৫ হাজার টাকা দিতে বলেন উপসচিব। কিন্তু এত টাকা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজে সব কিছু করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এতে খরচ হবে মাত্র ১৬০০ টাকা। সপ্তাহ দু’য়েক আগে এসে তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে তিনি সবকিছু শুনে হলফনামাসহ আবেদন করার পরামর্শ দেন।
মান্দি জানান, আবেদন পরবর্তী সেটি এপ্রুভালের (অনুমোদন) জন্য মেহের আফজল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে যান। কিন্তু প্রধান শিক্ষককে নাকি বোর্ডের উপসচিব অনুমোদন দিতে নিষেধ করে দেন। অবশ্য পরে প্রধান শিক্ষক অনুমোদন দেন। পরবর্তীতে শিক্ষাবোর্ড থেকে ফোন করে সোমবার (গতকাল) কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
মান্দি ডি কস্টা বলেন, ‘আজ (সোমবার) কমিটির সভায় যোগ দিতে যাওয়ার পর আমাকে পদে পদে হয়রানি করা হয়। সভায় আমার আবেদনপত্র তোলা হয় সবার শেষে। আমাকে বসিয়ে রেখে মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে আমার আবেদন তোলা হয়। সেখানে আমার বাবা-মায়ের বিষয়ে তারা কথা বলতে শুরু করেন। আমার ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা শুরু করেন।
আমি প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান আমাকে বেয়াদব ডেকে শাসাতে থাকেন। আমি বলি, আপনি আমার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করতে পারেন না। উনার নির্দেশে নিরাপত্তা কর্মীরা আমার ব্যাগ ছিঁড়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বোর্ডের গেটের বাইরে বের করে দেন। আমি বুঝতে পেরেছি, উপসচিবকে টাকা না দেওয়ায় আমাকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।’
যদিও টাকা দাবির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষাবোর্ডের উপসচিব বেলাল হোসেন। গণমাধ্যমে তিনি দাবি করেছেন, ‘তাকে (মান্দি) আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন এক সাংবাদিক। আমি কেন টাকা চাইব, প্রশ্নই আসে না। আমি আইন অনুযায়ী তাকে পরামর্শ দিয়েছি। নাম সংশোধন করবেন চেয়ারম্যান স্যার, কমিটির সদস্যরা। এখানে আমার তো করার কিছু নেই। সে বোর্ডে এসে একটা ঘটনা ঘটিয়েছে। চেয়ারম্যান স্যারের দিকে ফাইল ছুঁড়ে মেরেছে। এখন দোষ আড়াল করতে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে।’
শিক্ষাবোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডের উপসচিব নাম-বয়স সংশোধনী কমিটির সদস্য নন। বোর্ডের বিভিন্ন শাখা প্রধানরাই এ কমিটির সদস্য। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর বিশেষ আমন্ত্রণে উপসচিব বেলাল হোসেনকে বোর্ডের নাম-বয়স সংশোধনী কমিটিতে যুক্ত করেছেন।












