মানব কল্যাণের জন্য কালে কালে যুগে যুগে জ্ঞানচর্চা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। কিন্তু কোভিড-১৯ নোভেল করোনা ভাইরাস এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব সারা বিশ্বে এক মহামারী আতন্েকর কারনে সব জ্ঞানপীঠ বন্ধ হয়ে যায় জীবন রক্ষার তাগিদে। সেই ২০১৯ সালের শেষ থেকে প্রায় দুই বছর অবধি পুরো বিশ্ব স্থবির আতংক মহামারী ও মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। পুরো বিশ্ব হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। মানুষের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে শূন্যের কোটায় এসে পৌঁছেছে। একে অন্যের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ, সম্ভাষণ ও আলাপ নেই বললেই চলে। সকলের মনে অজানা ভীতি আর সংশয়ে চঞ্চল জীবন পুরোদমে বিচ্ছিন্ন যেন মৃত্যুর ভয় পিছু ছাড়ে না কারো। সর্বমোট প্রায় আটচল্লিশ লক্ষ মানবের জীবনাবসান হয়েছে। কি আর্তনাদ পুরো পৃথিবীতে! সারাবিশ্বের রাজধানী খ্যাত উত্তর আমেরিকার নান্দনিক ব্যয়বহুল ঘনবসতিপূর্ণ চাকচিক্যময় আলোর শহর নিউইয়ক এক ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। শুধু সারি সারি মৃত্যুর মিছিল সম্বলিত লাশবাহী গাড়ি বহরে শহরের সব ব্যস্ততম রাস্তা দখল করে নিয়েছিল। এরূপ ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের লেখাপড়া শেখার সর্বস্তরের স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে করে কোমলমতি শিশুদের মুক্তবিহঙ্গে আনন্দের পদচারণা নিশ্চুপ হয়ে যায়। বলতে হয়,এক ধরনের ইট-পাথরের দেয়ালে আলো বাতাসহীন অন্ধাকারাচ্ছন্ন বন্ধ দ্বারে জনমানবশূন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশেএই প্রাণচাঞ্চল্য নিষ্পাপ হাসিমাখা আদুরে প্রাণের সোনামণিদের প্রাণ বাঁচানোর দ্বায়ে বন্দীত্ব জীবনে আটকে রাখতে হয়েছিলো। মাতা-পিতা প্রিয় সন্তানদের প্রাণ বাঁচানোর আর মহামারী কবল থেকে সুরক্ষার জন্য একরকম নির্জন, নীরব মানবের ছোঁয়া থেকে শতশত হাত দূরে এই অবুঝ শিশুদের বুকে বেঁধে রেখেছিল। কোমলমতি শিশুরা সবসময় মানুষের আদর ভালোবাসা স্নেহের মধ্যে মানবঢালে থাকতো এই মহামারীতে পুরো উল্টো পরিবেশে বাস করতে হলো দীর্ঘ প্রায় দুই বৎসর। এই যেন এক সাক্ষাত প্রকৃতির বিপর্যয় বা অভিশাপ। জীবন রক্ষা করা যেখানে অনিশ্চিত সেখানে পড়ালেখা, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কাজকর্ম, অফিস আদালত, ব্যাংক, বীমা এবং খেটে খাওয়া শ্রমিকের জীবনও স্থবির বলতে হয় পৃথিবীর অর্থনৈতিক সব চাকা বন্ধ হয়ে রুদ্ধতার সময় পার করেছে। শুধু চতুর্দিকে মৃত্যুর মিছিল, যে মিছিলে আপন অতিপ্রিয় স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা কেউ কাছে থাকেনি এমন মহাবিপদে প্রিয় বিচ্ছেদেও। মানুষের স্বভাবত ধর্ম নিজেকে ভালোবাসা আর আপন প্রাণকে রক্ষা করা তা আবারও প্রমাণিত সত্য। সেই প্রাচীন আদিম যুগে পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রয়োজনে মানব জাতি প্রকৃতি থেকে শিখতে শুরু করেছে। তারপর নারী জাতি কর্তৃক কৃষির উদ্ভাবন এবং পুরুষ জাতির পশু শিকারের মধ্য দিয়ে খাদ্যাভ্যাস ও সুসংগঠিতভাবে বাস করা প্রথম শুরু হয়। যা ক্রমান্বয়ে গোষ্ঠী, সমাজ, সমপ্রদায় এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রতে পরিনত হয়েছে। প্রকৃতি মানবজাতির আদি শিক্ষক। এই বিশাল বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি মানুষকে দান করেছে কত শত জ্ঞান-বিজ্ঞান। প্রকৃতি থেকে শিখতে শিখতে মানবজাতি হয়েছে উন্নত এবং মানবের চিন্তাজগতকে করেছে উৎকর্ষ। যুগে যুগে কালে কালে শিশুদের প্রথম হাতেখড়ি ছিল পরিবারে যা গর্ভধারিণী মমতাময়ী মায়ের হাত ধরে শুরু হতো পরম আদর আর মমতায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশে আস্তে আস্তে আরো গভীরভাবে মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে উজ্জীবিত করার মানসে এবং ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণ করার নিরপেক্ষ শক্তি ও সাহসে প্রথামুক্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠলো মক্তব, পাঠশালা, বিহার, মন্দির, গীর্জা ও মাদ্রাসা। কালের পরিক্রমায় মানব জাতির অপরিসীম চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা, উন্নত মানসিকতা ও জ্ঞান সাধনার প্রচেষ্টা থেকে শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাই শিশু বয়স থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য মনের আনন্দে আজ ছুটে চলে নিজেদেরই পছন্দমত নামকরা বাংলা/ইংরেজি/আরবীসহ আরো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোতে। এক সময় স্কুল বন্ধ থাকবে শুনলে সকল বয়সের শিক্ষার্থীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উল্লাস করতো আর গলা ফাটিয়ে গান ধরতো সেই কবিগুরু কাছে আশ্রয়, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি’।
দীর্ঘ আঠার মাস যা ৫৪৩ দিন পর স্কুল খোলার সংবাদে সব বয়সের শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে আনন্দের বন্যা, নাচানাচি, আনন্দমুখর পরিবেশে অনেকটা বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার স্বস্তি। অন্যদিকে শিক্ষকগণও প্রিয় ছাত্রছাত্রীকে বরণ করে নেওয়ার মুহূর্তটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্কুল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা, মাঙ বিতরণ, শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা, নানাধরনের সাজসজ্জা, বাদ্যধ্বনি, বেলুন, চকলেট ও ফুল বিতরণ করেন। স্কুল খোলার আনন্দ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সকলের মনে প্রশান্তির চাপ থাকলেও আবার অজানা আতঙ্ক কোভিড-১৯ ছড়াবে কিনা সেই চিন্তেও ভর করেছে। তাই সর্বত্র শ্রেণীকক্ষে পড়ার বিষয়ের চেয়ে কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রিয় শ্রদ্ধাবান শিক্ষকমণ্ডলি।
শিক্ষকগণ মানুষ গড়ার কারিগর। সেই গুরুপূজা বা গুরুর সম্মানে প্রতিবছর ৫ই অক্টোবর ইউনেস্কো স্বীকৃতিতে পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। আমিও আজ যাঁদের কাছ থেকে একটি শব্দও শিখেছি এখনও প্রতিনিয়ত জীবনের প্রয়োজনে শিখছি সেই গুণী পণ্ডিত বিজ্ঞজনদের কাছে আজীবন ঋণী থাকলাম এবং কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানাই। শিক্ষকগণ কোমলমতি শিশু বয়স থেকে আর্দশ ও নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত প্রজ্ঞাবান জাতি গঠনে অবদান রাখেন। দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়ে প্রবেশ থেকে প্রতিটি সময় মানবজীবন উন্নত সমৃদ্ধ করার লেসন বা পাঠ থাকে। শিক্ষকের সাথে প্রথম দৃষ্টিতে সালাম দেওয়া যা বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়, স্কুল ড্রেস পড়ার নিয়ম ধনী- গরীবের বৈষম্য দূর করে সাম্যের শিক্ষা দেয়, সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়িয়ে এসেম্বলি থেকে শৃঙ্খলা, সুরা বা ধর্মীয় আবহে আবার শপথ পাঠ সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মীয় শিক্ষা সাথে সত্যবাদিতা সর্বোপরি জাতির সংগীতের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের অনন্য শিক্ষা দিয়ে থাকে। তেমনি শরীরচর্চা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শরীর ও মনকে মজবুত শক্ত ও রোগ প্রতিরোধ বাড়ানোর শিক্ষা দিয়ে থাকে। এভাবে শিশুর মানসিক বিকাশে সৃজনশীল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মননশীল ও প্রতিভাবান হিসাবে গড়ে তোলেন প্রিয় শিক্ষকগণ। এককথায় শিক্ষকের এমন অসাধারণ ভালোবাসামাখা জ্ঞান বিতরণে এবং শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা আর শিষ্টাচারে আজকের একুশ শতকের বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্মরাই সুনাগরিক হিসাবে নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবে। সেই সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলি, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’
পরিশেষে অনুভবে বলতে চাই, প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা মনের আনন্দে পাঠে মনোযোগী হয়ে দীর্ঘ বিরতিতে জটবাঁধা বিষয়াদি দ্রুত শেষ করবে। সময়ের সাথে চলতে অদম্য প্রাণশক্তি, সাহসী ও সত্যানুসন্ধানী হবে। পরিবার আর বিদ্যালয় হয়ে উঠবে আত্মশুদ্ধির অন্যতম পাঠশালা। বাঙালির ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের শিক্ষা প্রজন্মদের মননে, চিন্তনে, ধারণে, প্রকাশে, আচরণে ও অনুশীলনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলি যদি প্রকৃত জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে পারেন তাহলে আমরাই হবো বিশ্বে জ্ঞানে বিজ্ঞানে আদর্শে সমৃদ্ধ উন্নত বাঙালি জাতি। শিক্ষা হোক আনন্দের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক প্রতিনিয়ত আনন্দমুখর। শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হোক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর বন্ধুত্বের। সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করে, সচেতনতা মেনে চলে এবং কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে নিজে রক্ষা করি। আলো আসুক প্রাণে। আলোকিত হোক প্রিয় প্রজন্ম। আমাদের সকলের লক্ষ্য হোক ‘ডু অল থিন্কস অয়েল’।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী