আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস আজ। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৪৫/১০৬ নং সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের মাধ্যমে ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে মনোনীত করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। এ দিবসের প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে জানা যায়, বিশ্ব জরায়ন পরিষদ কর্তৃক ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং একই বছর সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত জরায়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জরুরি কর্মপরিকল্পনার মতো উদ্যোগের ফলাফল হিসেবে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। বলা বাহুল্য, প্রবীণদের কল্যাণ সাধনে কাজ করছে জাতিসংঘ বিশ্ব জরায়ন পরিষদ।
একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হয় মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে। মানব সম্পদ হলো দেশের আপামর জনসাধারণ। একটি দেশ মানব সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, মানব উন্নয়ন উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। একটি দুর্বল জাতিকে সামরিক শক্তির প্রহরায় বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে সেই দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানব সম্পদ প্রভূত অবদান রাখতে সক্ষম। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রাকৃতিক সম্পদহীন জাপানের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি তাদের মানব সম্পদ। তাছাড়া, জনগণকে মানব শক্তিকে পরিণত করা সম্ভব হলে অধিক জনসংখ্যা কখনোই সমস্যা হয় না। দেশের যুবক সম্প্রদায়, প্রবীণ জনগোষ্ঠী, সক্ষম ভূমিহীন, বেকার, অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, নিরক্ষর-সবাইকে নিয়ে মানব সম্পদ। তাই সব বয়সের মানুষ সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের বিশ্ব জরায়ন পরিষদ কয়েক দশক ধরে বিশ্ব জনসংখ্যার হার পর্যবেক্ষণ করেছে। তাদের হিসেব অনুযায়ী বিশ্ব জনসংখ্যা উচ্চ জন্ম ও মৃত্যু হার থেকে জন্ম ও মৃত্যু হার কমের পথে লক্ষ্যণীয় উত্তরণ অব্যাহত রেখেছে। এই উত্তরণের মূলে রয়েছে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা ও অনুপাত বৃদ্ধি। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি দশজনের মধ্যে একজনের বয়স এখন ৬০ বা তার বেশি। ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনে একজন হবে ৬০ বা তার বেশি বয়সী। ২১৫০ সালে প্রতি তিনজনে হবে ৬০বছর বা তার বেশি বয়সের। প্রবীণ জনসংখ্যার অগ্রগতি ঘটছে। প্রবীণ জনসংখ্যার মধ্যে ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে, প্রবীণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থাৎ পঞ্চান্ন ভাগ নারী। এদের অবস্থান, মর্যাদা ও বসবাসের মূল্যায়ন সমাজ কীভাবে করছে, তা দেখার বিষয়। যে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তি থাকেন, তাঁর চলাফেরা ও জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের মনোযোগী হতে হয়। মনে রাখা জরুরি যে, পারিবারিক কর্তব্য নাগরিক কর্তব্যের অংশ। পরিবারের সকলকে সুখী করা পরিবারের সকল সদস্যের পারস্পরিক কর্তব্য। ‘রাইটস ইমপ্লাই ডিউটিস’ বলে একটা কথা আছে। অধিকার ও কর্তব্য যে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তা একথা থেকেই বোঝা যায়। প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে পরিবারের অপর সদস্যদের অবগত হতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তিরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও যেন বোঝা না হন, সে বিষয়ে সচেতনতা দরকার। প্রবীণ বয়সে নির্ভরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় সমাজের ওপর এর আর্থ সামাজিক অভিঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। এক সময় পরিবারে হাল ধরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি যখন উপার্জনে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বহীন ব্যক্তি ও সমাজের বোঝা। তাঁরা অনাদর, অবহেলা, বিদ্রূপ, কটাক্ষ, যথাযথ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করতে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বে প্রবীণরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। এটা একদিকে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন অন্যদিকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। তাই প্রবীণদের অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাঁদের শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখলে সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে-এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রবীণদের দিনগুলো যেন আনন্দের ও স্বাচ্ছন্দ্যের হয়, সে ব্যাপারে অন্যদের খেয়াল রাখতে হবে। এটা শুধু পারিবারিক দায় নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়ও।