এই পরিবর্তনে খুলে যাবে বিশ্বের জানালা
“প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমই হবে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। আগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ছিল ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ‘উদ্দেশ্যভিত্তিক’। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। বিদ্যমান পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির পাবলিক সমাপনী পরীক্ষা- পিইসি ও জেএসসি বাতিল হবে। নবম শ্রেণিতে থাকবে না সায়েন্স, আর্টস, কমার্স নামে বিভাগ বিভাজন। দশম শ্রেণির পাঠ্যবিষয়ের ওপরই হবে এসএসসি পরীক্ষা। এইচএসসির মূল্যায়ন হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুই পরীক্ষায়। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অষ্টম শ্রেণি থেকে ‘কর্মমুখী’ শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ থাকছে নতুন কারিকুলামে।”
খবরটি পাঠ করার পর আমার মতো অনেকের মনে এক দারূণ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন অনেক আগেই হবার দরজার ছিলো। আমাদের সময় কাল আর আজকের সময়কালে আকাশ পাতাল তফাৎ থাকার পরও আমাদের পাঠক্রম আর পদ্ধতি ছিলো মান্ধাতা আমলের। এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই মনে হয় কতো ধরণের বৈষম্য ই না কাজ করতো। বাড়ীর একমাত্র ছেলে হবার কারণে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে হবে এটাই ছিলো ব্রত। কারণ বিজ্ঞান বিভাগে না পড়লে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার সুযোগ ছিলো না। যদিও সে ঘোর উচ্চ মাধ্যমিকে উঠতেই কেটে গিয়েছিল। মানবিক বিভাগে যাবার পর মনে হয়েছিল আমার মাথা থেকে ভারী ইট সরে গেছে। যে কারণে বোডরএর মেধা তালিকায় যেতেও বেগ পেতে হয় নি। কথাটা বললাম এই কারণে তলোয়ার রাখতে হয় খাপ মেপে। কোন খাপে কোন তলোয়ার তা জানাতে না পারলে সর্বনাশ ছাড়া লাভ নাই।
এতোদিন ধরে পাঠক্রম বা এই বিভাজন মূলত বলে দিতো তুমি ডাক্তার হতে পড়ছো। তুমি এসেছো হিসাববিদ হতে । আর তোমার পথ মাষ্টারী। এটা কোন জাতির বাচ্চা বা তরুণদের জন্য মঙ্গলের হতে পারে না। আমরা যারা দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে বসবাস করি আমরা এগুমলো অনেক আগেই টের পেতাম। আমাদের ছেলে মেয়েরা এসব দেশে এসে এইচ এস সির আগে বুঝতেই পারে নি কাকে বলে পরীক্ষা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোন ধরণের চাপ ও প্রতিযোগিতামূলক কিছু ই না দেখে ভাবতাম এরা মানুষ হবে কি ভাবেজ? পরে বুঝলাম মানুষ হবার জন্য যা যা দরকার সেটাই তাদের ধারাবাহিকভাবে শেখানো ও পড়ানো হয় । যার সাথে থাকে ব্যবহারিক ক্লাশ ও ভ্রমণ । আপনি নিজেই ভাবুন একটা ছাত্র বা ছাত্রী পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বাইরে দুটি কবিতা আর একটা ছোট গল্প ছাড়া ইতিহাস ভুগোল কিছুই জানেনা । ভাবুন যে ছেলেটি ইতিহাসে পাকা সে বোঝেই না কোথায় থাকে মানুষের লিভার। একটি মেয়ে যদি কেবল ডাক্তার হবার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সে সব বিষয় ছাড়া আর কিছু পাঠ না করে তার কাছে সমাজ ও মানুষের মূল্য কোথায়? সমাজ বিজ্ঞান না জানার যে কুফল তা এখন আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
বলা হয়েছে: “নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরা শেখাবেন। প্রাথমিকের জন্য আটটি বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে ‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না। এসব শিক্ষকরা শেখাবেন, এ জন্য নির্দেশনামূলক বই দেওয়া হবে। আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
এর চাইতে সুখবর আর কি থাকতে পারে? উন্নত দেশো সমাজে এটাই নিয়ম। এখন যেটা প্রশ্ন এসব বিষয় একসাথে পড়ানো ও তাদের তৈরী করার মতো যোগ্য পরিবেশ শিক্ষক সমাজ আছে কি না। এখন অবধি তা নাই। কারণ এতোদিনের প্র্যাকটিসে আমাদের সমাজে আমরা যেসব টিচারদের পেয়েছি তাঁরা স্পেশালাইজড। কেউ অংক কেউ বিজ্ঞান কেউ বা ভুগোল বিশারদ। এখন লাগবে সব বিষয়ে জানা এবং পড়াতে পারা টিচার। বিশ্ব নাগরিকত্ব ও জলবায়ু বিজ্ঞানের মতো আধুনিক ও জটিল বিষয়ের অন্তর্ভূক্তি ছিলো সময়ের চাহিদা। এ দুই বিষয় এখন যে কোন ডাক্তার বা প্রকৌশলীর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। বদলে যাওয়া বিশ্বে আমাদের সামনে যে নতুন নতুন চ্যালেন্জ তার ভেতর পরিবেশ প্রধানতম। যদিও এখন করোনার চাইতে ভয়াবহ কোন সমস্যা সামনে নাই। কিন্তু করোনা একসময় বিদায় নেবেই কিন্তু পরিবেশ দূষণ যাবে না।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি এসব বিষয় কৈশোর থেকে না জানলে আমাদের দেশের বালক বালিকারা দুনিয়ার সাথে তাল মিলাতে পারবে না। একটা কথা মনে রাখবো দীঘর্কাল আমরা কেরাণী তৈরীর পড়ালেখা শিখিয়েছি এবং শিখেছি। সাথে ছিলো সামন্ততন্ত্র। জমিদার জোতদার শেষে রাজা বাদশাহের আমলে আমাদের দেশের ভবিষ্যত যারা নির্ধারণ করতেন তাদের আধুনিকতা বিষয়ে না ছিলো ধারণা না কোন বিচার বিবেচনা। আজকাল সমস্যার ধারণ ও গেছে বদলে। কথায় কথায় যে জঙ্গীবাদ উগ্রবাদ সহ নানা উটকো বিষয় দেশ ও সমাজকে আক্রমণ করতে উদ্যত তাদের ঠেকাতেও চাই বাস্তবতার সাথে দুনিয়ার সাথে চলতে পারার মতো আধুনিকতা। সে আধুনিকতা দেবে এই পরিবর্তন।
কিভাবে মূল্যায়ন হবে বা কে কিভাবে পাস করবে সামনে যাবে সে বিষয় এখন তুচ্ছ হয়ে বড় হয়ে উঠবে জানার আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রজ্ঞা ও মননে জেনেছিলেন শিক্ষার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আনন্দ। যে সব বিষয়ে ছাত্র ছাত্রীরা জানবে তার সাথে যেন ভয়ের কোন সম্পর্ক না থাকে। আমাদের কৈশোর ও যৌবনে লেখাপড়ার নাম ছিলো বিভীষিকা। আর কিছু কিছু টিচার মানেই ছিলেন ভয়ের প্রতীক। সে সব অনেক বিষয় এখন নাই। কিন্তু এখনো রেজাল্ট বের হবার পর আমরা দেখি আত্মহননের করুণ সংবাদ। এসব সংবাদ বন্ধ করতে পারে এই নতুন পরিবর্তন। সবচাইতে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় যে স্বপ্ন ও অগ্রযাত্রার কথা বলেন তার জন্য এই পরিবর্তন ছিলো জরুরী।
শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি ও তাঁর টিমকে জানাই অভিনন্দন। ভালোবাসা নবীন প্রজন্মের জন্য। যারা আগামী দিনে জানবে লেখাপড়া মানুষের মতো মানুষ হ ওয়া আর আনন্দ বসবাস করে একজায়গায় একসাথে। জয়তু বাংলাদেশ এগিয়ে চলো এসব তারূণ্যের ওপর ভর করে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট