সূরা নাস্র’র তাৎপর্য ও শিক্ষা
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করুন। তাঁর গুণগান ও প্রশংসা করুন। জেনে রাখুন, একমাত্র আল্লাহই বিজয় ও সাহায্যদানকারী। দ্বীনের পথে বিজয় ও সাফল্য অর্জনে মহান প্রভূর সাহায্য কামনা করুন।
সূরা নাসর প্রসঙ্গ:
নসর শব্দটি আরবি এর অর্থ সাহায্য, বহুবচন আনসার। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১০ তম সূরার নাম সূরা নাসর। এতে আয়াত সংখ্যা ০৩, পদ ১৭, বর্ণ ৭৭, রুকু সংখ্যা:১, পরা ক্রম: ৩০, তাফসীরকারদের সর্বসম্মত মতানুসারে সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ। সূরাটি হাজ্জাতুল বিদা তথা বিদায় হজ্বের সময় মিনায় নাযিল হয়েছে। এ সূরার অপর নাম সূরা তাওদী বা “সূরা বিদা” কেননা এ সূরায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ইহকাল ত্যাগ করা তথা ওফাত শরীফের ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাফসীরে আযীযী ও তাফসীরে নূরুল ইরফান) এ সূরা নাযিলের দুবৎসর পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহকাল ত্যাগ করেন। [তাফসীরে খাযিন, মাদারিক ও তাফসীরে নুরুল ইরফান]
এ সূরার আরেক নাম সূরা ফাত্হ এ সূরায় ফাত্হ শব্দের উল্লেখ রয়েছে ফাত্হ অর্থ বিজয়, সূরাটি মক্কা বিজয়ের পূর্বে নাযিল হয়েছে। এতে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ রয়েছে। [তাফসীরে আযীযী, তাফসীরে নুরুল ইরফান]
হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এ সূরা নাযিলের পর “আল ইয়াউমা আক্মালতু লাকুম দ্বী-নাকুম”… আয়াত অবতীর্ণ হয়। এটি নাযিলের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশি দিন পৃথিবীতে ছিলেন। [তাফসীর খাযাইনুল ইরফান]
সূরা নাস্র’র অনুবাদ
১. যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে। ২. এবং আপনি লোকদেরকে দেখবেন যে আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে। ৩. অত:পর আপনি প্রতিপালকের প্রশংসাকারী অবস্থায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর থেকে ক্ষমা চান, নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত তাওবা কবুলকারী। [তরজমা, কানযুল ঈমান, সূরা: নসর, আয়াত: ১-৩]
সালাতুশ শুকর আদায়:তাফসীরে রুহুল বয়ান’র ব্যাখ্যা গ্রন্থ তাফসীরে ‘ফুয়ুজুর রহমান’ কৃত আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়াইসি (র.) ৩০ তম খন্ডে বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের শোকরানা হিসেবে নবীজি ক্বাবা শরীফের দরজা খুলে চার রাকাত নফল নামায আদায় করেছেন। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড:৩০, পৃ: ১০৯২]
সূরা নাসর তিলাওয়াতের পর সাহাবীদের আনন্দ ও এক সাহাবীর ক্রন্দন: হযরত মুকাতিল (র.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের মজলিশে সূরা নসর তিলাওয়াত করলে সবাই আনন্দিত হলেন, যেহেতু এ সূরায় মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ রয়েছে, সুরাটির তিলাওয়াত শুনে হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্রন্দন শুরু করলেন, নবীজি তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি আরজ করলেন আপনি তো এ সূরার মাধ্যমে আপনার ওফাতের বার্তা জানান দিয়েছেন। (আপনার বিচ্ছেদের বিরহ যন্ত্রণার কথা ভেবে ক্রন্দন করছি।) [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড: ৩০, পৃ: ১০৯৪]
হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা: সৈয়্যদানা মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেছেন, এ সূরা অবতীর্ণ হবার পর নবীজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এক দিন হুজুরা শরীফ থেকে বাইরে তাশরীফ আনলেন সাহাবাদের উদ্দ্যেশে বিদায় ভাষণ দিলেন, পূনরায় ঘরে ফিরে গেলেন, কিছু দিন পর নবীজি ওফাত বরণ করলেন। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড:৩০, পৃ: ১০৯৫)
হযরত ফাতেমাতুজ্জাহরা (রা.) কে নবীজির সান্তনা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) কে ডেকে নিজের ওফাতের সংবাদ দিলেন, হযরত ফাতেমা (রা.) শুনা মাত্রই ক্রন্দন করতে লাগলেন, নবীজি তাঁকে বললেন, ওহে কন্যা ফাতেমা! ক্রন্দন করোনা, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে সাক্ষাত করবে। এ সুসংবাদ শুনে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হাসলেন। [তাফসীর ফুয়ুজুর রহমান, পৃ: ১০৯৪]
অধিক পরিমাণ তাসবীহ ও ইস্তিগফার: উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, সূরা নসর নাযিল হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক পরিমানে পড়তেন “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী আসতাগফিরুল্লাহ ওয়া আতু-বু ইলায়হি। অর্থ:-পবিত্রতা আল্লাহর এবং তাঁর প্রশংসা সহকারে ইস্তিগফার করছি, আল্লাহর মহান দরবারে এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। [তাফসীরে নুরুল ইরফান]
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু ও সিজদায় অধিক পরিমানে “সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা আল্লাহুম্মাগফিরলি” পাঠ করতেন। [বুখারী শরীফ, তাফসীর ইবনে কাছীর, কৃত: আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাছীর (র.)]
নবীগণ নিস্পাপ পুত:পবিত্র: আল্লাহ নবীগণ ওহী প্রাপ্তির আগে ও পরে সকল প্রকার কুফরী থেকে পুত:পবিত্র। [তাফসীরে আহমদিয়া, পৃ: ২১২ কৃত: আল্লামা মোল্লা জিওন (র.)]
আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা মতে সকল সম্মানিত নবী রসূলগণ নবুওয়াত পূর্ববতী ও পরবর্তী সময়ে সকল প্রকার সগীরা ও কবীরা গুনাহ সমূহ থেকে পুত: পবিত্র।
নবীগণ নিস্পাপ হওয়া সত্বেও নিয়মিত অধিক পরিমানে তাওবাহ ইস্তিগফার তথা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, উম্মতকে শিক্ষার দেয়ার জন্য, অথবা নিজের গুনাহগার উম্মতের জন্যই ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। [‘তাফসীর নূরুল ইরফান’ কৃত: হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)]
সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে মানব মন্ডলী! আল্লাহর দরবারে তাওবাহ করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি আল্লাহর দরবারে দৈনিক একশতবার তাওবা করি। [মুসলিম শরীফ, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩, পৃ: ২৫০]
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর দরবারে দৈনিক সত্তরবারের অধিক ইস্তিগফার ও তাওবা করি। [বুখারী শরীফ, খন্ড:২য়, পৃ: ৯৯৩, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩য়, পৃ: ২৫০]
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষের গুনাহের পরিমান যদি সাত আসমান, সাত জমীন, সাতটি পাহাড়ের সমপরিমানও হয়, বিশুদ্ধ নিয়্যতে তাওবাকারীকে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রহমত দ্বারা মার্জনা করেন। [মুকাশিফাতুল কুলুব, পৃ: ১১৭, কৃত: ইমাম গাজ্জালী (র.)]
আল্লাহর দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে: হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, সূরা নসর অবতীর্ণ হওয়ার পর যখন পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াত “আল ইয়াউমা আকমালতু লাকুম দ্বী নাকুম” অর্থ:-আজকের দিনে আমি আপনার জন্য দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম, যখন অবতীর্ণ হলো সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পেয়েছিলেন নবীজি পৃথিবীতে আর বেশীদিন অবস্থান করবেন না, দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এ সূরা অবতীর্ণ হবার পর রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন, ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন তিনি ইচ্ছে হলে পৃথিবীতে থাকুক অথবা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করুক’ ঐ বান্দা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। এটা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার জন্য আমাদের জীবন, ধন সম্পদ, পিতা মাতা এবং সন্তান-সন্ততি সবই উৎসর্গ করলাম। [তাফসীর খাযাইনুল ইরফান, কৃত: সদরুল আফাযিল আল্লামা সৈয়দ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (র.)]
আরবের লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করলো: হযরত কাশফি (র.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন প্রতিনিধিদল যথাক্রমে বনী আসাদ, বনু মুররা বনী কালব, বনু কিনানাহ, বনী হিলাল, বনী তাসীম এর লোকেরা দলে দলে নবীজির সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলো।
হযরত আবু আমর ইবনে আবদুলবর বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের সময় সমগ্র আরবের একজন লোকও কাফির ছিলো না। সমগ্র আরবের অধিবাসীগণ ইসলাম গ্রহণ করলো। [ তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড: ৩০, পৃ: ১০৬০]
মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে তাঁর সাহায্য ও বিজয় দান করুন, নবীজীর আদর্শ অনুসরনে ইসলামের পথে আমাদেরকে কবুল করুন। নিশ্চয় আল্লাহ মহান দানশীল রাজাধিরাজ পূণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ মিনহাজুর রহমান
মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি।
প্রশ্ন: জানাযা নামাযের পর দুআ মুনাজাত করার ব্যাপরে শরীয়তের ফায়সালা কী? জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: জানাযা নামাযের পর ও মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর দুআ মুনাজাত করা শরীয়ত সম্মত মুস্তাহাব আমল। বিভিন্ন হাদীস শরীফ ও ফিকহ শাস্ত্রে এর বৈধতা ও উপকারিতা সম্পর্কে সমর্থন পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যখন তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযা নামায পড়বে অত:পর তার জন্য খালেস নিয়্যত নিষ্ঠার সাথে দুআ কর। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং:-৩১৯৯, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং:-৩০৭৭)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মৃত্যুর পর তিনটি আমলের অন্যতম একটি আমল হলো নেককার সন্তান যে পিতা মাতার জন্য দুআ করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং:-১৬৩১, তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং:-১৩৭৬, ওয়াকারুল ফাতওয়া, খন্ড ২য়, পৃ: ৩৫৬, কৃত: আল্লামা মুফতি ওকার উদ্দিন বেরলভি)
নবীজি তাঁর সাহাবী হযরত জাফর বিন আবি তালিব (রা.) এর জানাযা পড়ানোর পর তাঁর জন্য দুআ করেছেন মর্মে হাদীস দ্বারা প্রমানিত। জানাযার পর দুআ মুনাজাতের বৈধতার ওপর আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) “বাযলুল জাওয়ায়িজ আলাদ দুআ বাদা সালাতিল জানায়িজ” নামক একটি বিশ্লেশনধর্মী কিতাব প্রণয়ন করেছেন। [“আল আতায়ান নবভীয়্যা ফীল ফাতাওয়া আর রিযভিয়্যাহ” খন্ড: ৪র্থ, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা (র.)]