লেখালেখি করার সুবাদে পরিচয়। আবার দেখি আমাদের গ্রামে মামুনের বড়বোন বিয়ে দেওয়ায় আত্মীয়তার যোগসূত্র। এক সময় ছোটদের কাগজ কী লিটল ম্যাগ -‘কিশোর সমাবেশ’ সম্পাদনা করতেন। পোস্টে কাটিরহাট মহিলা কলেজে আমার কাছে মামুনের চিঠি যেতো। ম্যাগাজিন, ছোটদের পত্রিকা যেতো। ফারুক হাসান সম্পাদিত ‘কথন’ও যেতো। সম্ভবত কথনের আঙ্গিকে তখন অন্য রূপ ছিল। কিশোর সমাবেশের কোন এক সংখ্যা নিয়ে আমি আলোকপাত করেছি। তা দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়। ঐ ছাপানো অংশের আঙ্গিকে পাশাপাশি একটি চমৎকার দৃশ্য ছিল, যেখানে এক ঝাঁক হাঁস ওদের চ্যাপ্টা ঠোঁটে কাদামাটি জল থেকে খাবার খুঁজছে।
স্বকাল শিশুসাহিত্য সংসদের ‘ছড়াপত্র’ প্রথম সংখ্যা মামুন পোস্টে পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে আমি সেটির উপরে আলোচনা লিখেছি। দুরন্ত লিটল ম্যাগাজিনে তা ছাপানোর সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত শিশুসাহিত্যিকদের অনেকে সেই কাগজে লিখেছেন। ওই সময় এনায়েতপুর মনিয়াপুকুর থেকে এসে যোগ দিয়েছি ১ম কবিতা ও ছড়া উৎসবে। উৎসবের সংবাদ রমজান আলী মামুনের মাধ্যমে পেয়েছি। লেখালেখিতে উত্থানের জন্য আমি মামুনের কাছে কৃতজ্ঞ। এরপূর্বে মরহুম সাংবাদিক ওবায়দুল হকের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! মামুনের সহযোগিতায় কবিতা পাঠ এবং ছড়া পাঠে অংশ নিয়েছি। আমি তখন কাটিরহাট মহিলা কলেজে শিক্ষক এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছি। ইতোমধ্যে বড় বোনের আসন পেয়ে গেছি। টেরি বাজার থেকে মামুন আমাকে চিঠিতে লিখেন- ‘কিন্তু আপু মনটা ভালো ছিল না বলে / লোকালয় থেকে একেবারে গঙ্গা ফড়িং সবুজ প্রান্তরে ডুবে গিয়েছিলুম/ যেখানে নেই স্নেহ প্রীতি ভালোবাসার কৃত্রিমতা / উদার আকাশ /রূপালি নদী / সবুজ বিচালি / বুনোফুলের ঝোপ/আর ঝর্ণাধারায় মিইয়ে গিয়ে উঃ-কত সুখ / মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই/ সেখানটাতে, অনেক দূরে…..। যেখানে নেই কোন অভাব অনটন, দুঃখ হতাশার প্রচ্ছায়া / নেই দু’মুঠো অন্নের জন্য জীবন ঘানি টানার তাড়া/ ’(চিঠির অংশবিশেষ-১৪ সেপ্টেম্বর ৮৭)। এই চিঠিতে আরও অনেক সুন্দর কুশল বার্তা আছে। আমার বিয়ের জন্য আসা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কোনটা কিভাবে বাছাই করব, কেন দেরি করছি-এসবও আছে। তখন আমি অবিবাহিতা।
প্রকৃত কবি-সাহিত্যিক যেরূপ হয়, সেরূপ মামুন ও অন্তর্মুখী ছিলেন। একবার কোনো এক তীব্র মনোকষ্টের কথা প্রকাশ করলেন চিঠিতে-‘বুকের ভেতর প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে; সারাদিন সারারাত শুধু ছটফট করতে থাকি। কিন্তু মানবিকতার কারণে কিছুই করা হয়ে উঠে না। তাই প্রতিহিংসার বারুদে আমি শুধু জ্বলছি আর জ্বলছি। আপনার কবিতা সংগ্রহ করে রাখা ছিল, পাঠিয়ে দিলাম। বই নামকরণের ব্যাপারে আপনার মতামতই চূড়ান্ত করুন। তা না হলে বই বের করে শান্তি পাবেন না। এটা প্রত্যেক লেখক-লেখিকার বেলায় হয়ে থাকে।’ (২ ডিসেম্বর ৮৮)। খোঁজাখুঁজি করলে আমাকে লেখা মামুনের আরো মূল্যবান কিছু চিঠি হয়েতো পাওয়া যেত! কিন্তু বাসা বদলের নানা ঝক্কিতে সেগুলো কোথায়, জীবনের টানাপোড়নে এখন সময় পাই না খোঁজাখুঁজি করার! তবে আমি উত্তর সাজাই, তাকে নিবেদিত কবিতায়। ছোট ভাই মামুন আর ছোট নেই। হয়েছেন অনেক বড়, কবি-লেখক -শিশুসাহিত্যিক। প্রচুর বইও প্রকাশ পেয়েছে তার। মামুনের এ অগ্রযাত্রায় প্রতিনিয়ত আমার শুভকামনা ছিল। আমার লেখালেখির ভুবনে কবি-লেখক শিশুসাহিত্যিক রমজান আলী মামুনের অকৃপণ সহযোগিতা কখনো ভুলবার নয়। তাই ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯১৯ যখন হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলেন মামুন তখন আমি স্থির থাকতে পারিনি। শরীর কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ি, বাড়তি হার্টবিটের চাপে অবশেষে শুয়ে পড়ি। এমন চাপ সামলানো সত্যিই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। ৩৩ বছর ধরে আমি মামুনের ‘আপা’ ডাক শুনেছি। মাত্র ৫১ বছর বয়সে এমন ভাই কিছুই না বলে কোথায় হারিয়ে গেল! এই এক বছর ধরে ভাইকে খুঁজেছি!
ছোটদের বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব ২০১৯ এর ১৯, ২০, ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে মামুনের সবান্ধব সরব উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রায় সাড়ে তিন দশকের লেখালেখি জীবনের সার্থক স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রমজান আলী মামুন। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সর্বশেষ মামুন বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পুরস্কার গ্রহণ করেন।
দৈনিক আজাদী আগামীদের আসর (১৬মে ২০১৮) এ মামুনের একটি অসাধারণ কবিতা প্রকাশিত হয়। যতই পড়ি কবিতাটি, উপলদ্ধিতে চিরন্তন সত্য ভাস্বর হয়ে উঠে চোখের সামনে। কবিতার নাম ’কবর আছে কত’ সকালবেলা-সন্ধ্যারাতি শুন্য মানুষজন / তপ্ত দুপুর লু হাওয়া বয় এমনি দারুন ক্ষণ। বদর পীরের দরগাহ ফেলে সেইতো গোরস্থান / মা তো আমার শুয়ে আছেন বুক করে খান খান। এখন থেকে সেই বাড়িটায় নিত্য আসা যাওয়া /পাথর বুকে দাঁড়িয়ে থাকি-যায় না কাউকে পাওয়া, /পড়ছি দরুদ-করছি দোয়া মনের আবেগ ঢেলে / খবর আছে শূন্য হাতে সেই বাড়িটায় গেলে। একটু দূরে বাবার কবর ঝাপসা হয়ে আসে / আরেক পাশে বুবু আমার ঝলমলিয়ে হাসে। দাদার কবর কোথায় দেয়া নেই তো কারো জানা / ইতিহাসের খোঁজ নিতে তাই মন দিয়েছে হানা। আত্মীয় আর প্রতিবেশীর কবর আছে কতো/ করলে হিসেব একেক করে হয় যে শতো শতো। আজকে না হয় কালকে হবো সেই বাড়িটির সাথী/ ঠুনকো মোহে আমরা তবু রঙের খেলায় মাতি! রমজান আলী মামুনকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে তার আত্মার গভীর প্রশান্তি প্রার্থনা করছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,
মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।