শিক্ষা দিবসে শিক্ষায় পরিবর্তন নিয়ে ভাবনা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের খসড়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক অনুমোদনও মিলেছে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না। এসএসসির আগে থাকছে না কোন পাবলিক পরীক্ষা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শাখার বিভাজন থাকবে না, অভিন্ন বিষয়ে হবে পাঠদান। নতুন নিয়মে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। প্রস্তাবিত এ শিক্ষাক্রম ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু হবে। আর উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে ২০২৭ সালে। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর, শিক্ষা দিবস। শিক্ষা দিবসে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতির এ পরিবর্তনের বিষয়ে নিজেদের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন তিনজন শিক্ষাবিদ।

প্রফেসর আব্দুল মান্নান
প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ইউজিসি
কিছু পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশ কিছু পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত সাধুবাদ যোগ্য। জ্ঞানটা কখনো পরীক্ষা কেন্দ্রীক হওয়া উচিত নয়। এটি পঠন-পাঠন কেন্দ্রীক হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশে সেটি পরীক্ষা কেন্দ্রীক করে ফেলা হয়েছে। শিশুদের জন্য ভর্তি পরীক্ষাটাও আমার কাছে যুক্তিযুক্ত নয়। একটি শিশু ভর্তি হবে। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু জীবনের প্রথম ধাক্কায় তাকে আমরা পরীক্ষার মুখোমুখি করে দিচ্ছি। পাশ-ফেলের মুখোমুখি করে ফেলছি। তাই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশ কিছু পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী বলে আমি মনে করি।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এসএসসিতে পরীক্ষা হবে একমুখি। এটাও ভালো সিদ্ধান্ত। যা আগে ছিল। পরে পাকিস্তান আমলে বিভাজন করে দেয়া হয়। এখন সে-ই আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া।
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে মোটামুটি সব ইতিবাচক মনে হলেও একটি প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। সেটি হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই এই অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন করবেন। এক্ষেত্রে জটিলতা বা সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীরা শিক্ষকদের চাপ দেবেন। যাতে তাদের সন্তানদের মূল্যায়নটা ভালো হয়। নম্বর যাতে বেশি দেয়। আর প্রভাবশালী হওয়ায় শিক্ষকদের জন্য এই চাপ এড়ানোটা সম্ভব নাও হতে পারে। যার কারণে প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়নের বিষয়টি সঠিক ভাবে হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আমার মতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আগে যেভাবে হয়েছে, সেভাবে হলেই বরং ভালো। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হাতে নম্বর দিয়ে চলমান অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়নের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না। আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটি যৌক্তিক মনে হচ্ছে না।
শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সব ধরনের শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনাটা জরুরি। একইভাবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থাও। তবে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন যা-ই হোক, খসড়া তৈরিকালীন শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নেয়া উচিত ছিল।

প্রফেসর শাহেদা ইসলাম
প্রাক্তন চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড
প্রস্তাবনা ইতিবাচক তবে দুয়েকটি বিষয়ে ভিন্নমত আছে
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা না রাখার প্রস্তাবনাটি আমার শতভাগ মনে ধরেছে। এটুকুন বয়সে পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে খুদে শিক্ষার্থীদের মনে পড়ালেখা নিয়ে এক ধরনের ভীতি তৈরি করে দেয়া হয়। যা কোনভাবে মঙ্গল বয়ে আনার নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা না রেখে শ্রেণি শিখনের মাধ্যমে মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি আমার বেশ মনে ধরেছে।
আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে এইচএসসির ফল প্রকাশের বিষয়টিও আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের দুয়েকটি বিষয় নিয়ে আমার মত-ভিন্নতা রয়েছে। যেমন, প্রস্তাবনায় এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসএসি পরীক্ষা না রাখার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রাথমকি সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করাটা অত্যান্ত যৌক্তিক। কারণ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা ছাপিয়ে দেয়াটা কোন ভাবেই মানা যায়না। তবে জেএসসি পরীক্ষার বিষয়ে বোধহয় আরো চিন্তা-ভাবনা করা যায়।
কারণ হিসেবে বলতে হয়, জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কারণে এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে ভীতিটা কেটে যাচ্ছে। জেএসসিতে আর যা-ই হোক, শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতাটা অর্জন করতে পারছে। যা এসএসসি ও এইচএসসির ক্ষেত্রে কাজ দিচ্ছে। তাই প্রাথমিক সমাপনী বাতিল করলেও জেএসসির বিষয়ে আরো হয়তো পর্যালোচনা করা যায়। দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোন বিভাজন না রাখা এবং শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার বিষয়টিও আমার কাছে যথার্থ প্রস্তাবনা বলে মনে হয়নি। দশমের পাশাপাশি নবম শ্রেণির পাঠ্যসূচি/সিলেবাসের একটি অংশও এসএসসির আওতায় রাখলে আরো ভালো হতো।
আর মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ পাঠগ্রহনের সুযোগ না পেলে, পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়তে যাওয়াটা শিক্ষার্থীর জন্য একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে। তাই এসব বিষয়ে আরো পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি।

প্রফেসর জেসমিন আক্তার
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম কলেজ
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে
প্রস্তাবনায় বিশেষ করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা এবং প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা না রাখার বিষয়টি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। এর মাধ্যমে অবুঝ শিশুদের আর পরীক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হবে না। আনন্দ মনেই স্কুলে যেতে তাদের আগ্রহ বাড়বে। প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও আর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা বইতে হবে না। এই দুই পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা সেটি লক্ষণীয়। যা প্রত্যক্ষ ভাবে শিক্ষার্থীদের উপর প্রভাব ফেলে। এই দুটি পরীক্ষা (প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি) বাতিল করাটাই যথার্থ। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির আলোকে এসএসসি পরীক্ষার সিদ্ধান্তটিও আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি। নবম ও দশম, এই দুই শ্রেণির সিলেবাসের ভিত্তিতে পরীক্ষা নেয়া হলে সিলেবাসটা আসলেই বড় হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমবে। একই ভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির আলাদা পরীক্ষার বিষয়টিও ভালো দিক।
সবমিলিয়ে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে বলে আমি মনে করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবশেষে কুতুকছড়িতে হচ্ছে সেতু
পরবর্তী নিবন্ধঅনুমতি ছাড়া মামলার নথি প্রদর্শন করা যাবে না