বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নকল ও ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব ওষুধ বিপণনের জন্য রয়েছে বিশেষ একটা চক্র। সেই চক্রের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কই সব ধরনের কাজ করে থাকে। একসময় কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির তৈরি প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে অনেক শিশু মারা গিয়েছিল। জানা যায়, সেসব ওষুধ খেয়ে শিশুদের কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর পরীক্ষা করে তাতে ক্ষতিকারক ‘ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল’ নামের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পায়। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকলের প্রভাবে কিডনি যে কোনো সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। ২০০৯ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। উৎপাদন ব্যয় কমাতে কিছু ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘প্রোপাইলিন গ্লাইকলের’ পরিবর্তে বিষাক্ত ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করেছিল। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল রাসায়নিক রং, বলপেনের কালি, সিলপ্যাডের কালি, মুদ্রণ কালি, প্লাস্টিকে দ্রবণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওষুধ প্রয়োজন। কিন্তু সে ওষুধ যদি জীবনরক্ষার পরিবর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে, তাহলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। ওষুধ ভালো না মন্দ, নকল না আসল তা যাচাই করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। মানসম্পন্ন ওষুধ কিংবা ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কেও মানুষের ধারণা থাকার কথা নয়। তবে সাধারণ মানুষের স্বভাবসিদ্ধ ধারণা হলো, ওষুধ তৈরিতে গুণগত মান বজায় থাকে। নকল পণ্য তৈরি হলেও নকল ওষুধ তৈরি হতে পারে কিংবা ওষুধের গুণগত মান নিম্ন হতে পারে, এটা সাধারণ মানুষের মাথায় কখনো আসে না। তাই যে কেউ যে কোনো জায়গা থেকে ওষুধ ক্রয় করে। এমনকি খোলাবাজার থেকেও। আমাদের এই অতিবিশ্বাসের স্থানেই ঘটে বিপত্তি। ফলে ক্রেতার কাছে সহজেই চলে যায় নকল বা ভেজাল ওষুধ। শুধু তাই নয়, ভেজাল ওষুধের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণির বিক্রেতা। এসব ওষুধ ব্যবহারের ফলে রোগী আরোগ্য লাভের পরিবর্তে নানা নতুন রোগে আক্রান্ত হয়।’
অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেকগুলো অর্জন আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বাইরে এমন কিছু প্রভাব আছে, যেটা স্বাস্থ্য খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, নগরায়ণ ইত্যাদি। কমিউনিকেবল ডিজিজ মোকাবিলায় অনেকটা সফলতা অর্জন করেছি। কিন্তু নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ এত বিস্তার লাভ করেছে যে এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে। এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। প্রয়োজনীয় সম্পদের সংকট রয়েছে। কিন্তু সম্পদ যতটুকু আছে, তার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে হবে। এখন প্রযুক্তির ব্যবহার এসেছে। এটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। প্রযুক্তির মাধ্যমে মানসম্মত সেবা দেওয়া যায়। আবার স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেছেন, এসডিজির ৩ নম্বরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত আজ একটি কৌশলগত অ্যাজেন্ডা। যেমন পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে, তাহলে তাঁদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে। এটা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দের জন্য দক্ষ নীতিনির্ধারক প্রয়োজন। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে, তাহলে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে দারিদ্র্য বাড়বে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য মানুষকে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু এই খাতে ব্যয় কমানোর জন্য সরকারকে আরও জোরদার ভূমিকা নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের তদারকব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের আরও বেশি উন্নয়ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের হাতের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গেছেন। একটি নামকরা মেডিকেল জার্নাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জরুরি নয়। অনেক দেশ আছে, যাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। তারপরও এসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগিয়ে গেছে। জাপান ও বিশ্বব্যাংক ২ বছর ধরে ১১টি দেশে একটি গবেষণা করেছে। গবেষণার উদ্দেশ্য, কীভাবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োগ করা সম্ভব। এ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। এই গবেষণামতে বাংলাদেশে অদক্ষ সেবাদানকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের অনুপাতের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরামর্শ আছে। এটা হলো একজন ডাক্তার থাকলে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকবেন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আরও অনেক বেশি নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।