দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

দুয়ারে দাঁড়ায়ে শকট
হাতফোনের পর্দায় যখন জ্বল জ্বল করতে দেখলাম স্থানীয় সময় ৯টা বেজে ১০, ঠিক সে সময়েই দীপ্র গভীর মনোযোগে ফোনের ঐ প্রান্তের কথা আত্মস্থ করে ঘোষণা করল যে , দুয়ারে দাঁড়ায়ে শকট আমাদের। এমনিতে চায়নিজদের সময়জ্ঞান কেমন জানি না; তবে কুনমিং আর বেইজিং, এই দুই জায়গাতেই হোটেল মারফত ঠিক করা শোফাররা দেখছি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। তবে শুনেছিলাম যে নতুন কারো সাথে প্রথম দেখা করতে গেলে চায়নিজরা এমনিতেই খুব সময়নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে থাকে। ঘটনা তা যা’ই হয়ে থাকুক, আমাদের যাত্রার সময় যেহেতু ঠিক করেছিলাম হবে সাড়ে নয়টা, সে মোতাবেক শোফার যেহেতু চলে এসেছে বিশ মিনিট আগেই, এখন আমাদেরও মানতে হবে সেই সময়। আগে না হউক একদম কাঁটায় কাঁটায় যাতে সাড়ে নটাতেই বেরিয়ে যেতে পারি হোটেলের এলাকা থেকে সে ব্যাপারে সচেতন হওয়ার ব্যাপারে দিতে হবে এখন সবাইকে তাড়া। অন্যদের তাড়া দেওয়ার আগেই নিজের ভেতরের তাড়ায় নিজেরই অজান্তে খাওয়ার গতি দ্রুত হয়ে যেতেই সবাইকে বললাম, দেখো ব্যাপারটা কিন্তু এখন আমাদের দেশের মান ইজ্জতের। সাড়ে ন’টায় এখান থেকে রওয়ানা দেব বলে দিয়েছিলাম গতকাল কন্সিয়ার্জে গাড়ি ঠিক করার সময়; সে মোতাবেক গাড়ি কিন্তু এসে হাজির বিশ মিনিট আগেই। না এজন্য বলছি না যে, এক্ষুণি আমাদের রওয়ানা দিতে হবে। তবে কথা হচ্ছে যে ঠিক সময় মতো যেন রওয়ানা করতে পারি আমরা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অতএব দ্রুত নাস্তা শেষ করে, কারো যদি বথারুমে যাওয়ার দরকার পড়ে তা সেরে, সবাই যেন নিচে নেমে যেতে পারি অন্তত ৯টা ২৫ এর মধ্যে সেদিক টা খেয়াল রাখতে হবে সকলের। শত হউক আমাদের কারণে চায়নার মাটিতে বাঙালির সময়জ্ঞান বিষয়ক মান যেন না যায়!
ঘুম থেকে উঠে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ধোঁয়াশা মোড়া গোমড়ামুখো সকালের আকাশে সূর্যের বা রোদের ছিটেফোটাও না দেখতে পেলেও, এমুহূর্তে মনে হচ্ছে দিনটা ভালই যাবে। কারণ একটু আগে সময়ানুবর্তীতা নিয়ে দেয়া নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাতে কাজ দেখছি ভালই হয়েছে। সবাই বেশ ঝটপট তৈরি হয়ে গেছে যার যার করণীয় দ্রুত সেরে । রুম থেকে বেরুবার আগে, গতরাতে বহু কষ্টে বয়ে নিয়ে আসা বড় বড় পানির বোতলগুলো থেকে দুটো নিয়ে নিলাম গাড়িতে রাখার জন্য। জানি না তো কুনমিং ইন্টারকন্টিনেন্টাল রিসোর্টের মতো এরা যদি গাড়িতে মুফতে পানি না দিয়ে দেয় তবে, পথে পানি কেনার হাঙ্গামা থেকে বাঁচার জন্য এ ব্যবস্থা। অতো বড় পানির বোতল নিতে দেখে লাজু বলল যে, ও থেকে খাবে কিভাবে পানি কেউ? অত্যন্ত যৌক্তিক সেই কথার কোন উত্তর না দিয়ে, রুমে দেয়া পানির খালি ছোট বোতলগুলোও নিয়ে নিলাম গোটা চারেক সাথে। গাড়িতে উঠে বড় বোতল থেকে পানি ঢেলে একটা একটা ছোট বোতল ধরিয়ে দেব সবার হাতে এই ভেবে।
লিফটে নিচে নামতে নামতে সবার দিকে চকিতে একটা চোখ জরীপ করে বোঝার চেষ্টা করলাম যে বাইরের হিম সাগরে ঝাপ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি আছে কার কেমন? দেখে মনে হল নাহ সবাই বেশ ভালই প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে হাতে কারো হাত মোজা না দেখে জিজ্ঞেস করলাম আছে কি না সবার সাথে ওটা। যদিও এ মুহূর্তে আমারও হাত উদোম, মানে গলাইনি দস্তানা যথাস্থানে তবে পকেটে রাখা আছে ওটা ঠিকই, যাতে সময় মতো গলিয়ে দিতে পারি হাত তার ভেতর। সবার কাছ থেকে হাতমোজা বিষয়ক প্রশ্নের হ্যাঁ সুচক জবাব পেয়ে, লিফট থেকে বেরিয়ে এগুলাম কন্সিয়ার্জ ডেস্কের দিকে।
ঐদিকে হাঁটতে হাঁটতে ঐ ডেস্কে এখন মিস ইনা আছে কিনা ডিউটিতে তা বোঝার চেষ্টা করেও ঠিক বুঝতে পারলাম না, আদৌ আছে কি না কেউ ওখানে। কারণ কাউন্টারটা খালি দেখা যাচ্ছে। এ অবশ্য হওয়ার কথা নয়। মানে ঐ কাউন্টার এ রকম খালি থাকার কথা নয় অন্তত এ সময়। হয়তো আছে যারা ওখানে ডিউটিতে, বসে আছে তারা উঁচু ঐ কাউন্টারের ওপাশে, তাই দেখতে পাচ্ছি না এখান থেকে। লবিতে চোখ বুলিয়েও দেখলাম সুনসান ওটা। খুব একটা লোকজন নেই। হতে পারে এই হোটেলেবাসিদের যারা এসেছে আমাদের মতোই ঘোরাঘুরি করতে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে হোটেল থেকে। বাকিরা হয়তো আছে এখনো রেস্টুরেন্টের ব্রেকফাস্ট টেবিলে। অবশ্য এই হোটেল টা দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে যারা উঠেন, আসেন তারা বেইজিং এ ব্যবসায়িক বা অফিশিয়াল কারণেই। আর ওসব কারণে যারা এসেছেন তারা নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে হোটেল থেকে, এরই মধ্যে; কারণ আকাশের অবস্থা আর বাইরের আবহাওয়া যাই হউক, বাজে তো এখন ৯ টার উপর। যদিও জানা নেই এখানকার অফিস আদালতের সময়সূচী, তারপরও সকাল নটার মধ্যে টো অফিস আদালত খুলে যাবারই কথা।
ইতোমধ্যে কন্সিয়ার্জ ডেস্কের দশ মিটারের মধ্যে পৌঁছে যেতেই ভোজবাজির মতো কোত্থেকে যেন হঠাত করেই উদয় হলেন, হোটেলের কালো স্যুট পড়া ছিপছিপে গড়নের মিস ইনা। চোখাচোখি হতেই, দ্রুত হাত নেড়ে ডাকতেই বাড়িয়ে দিলাম হাঁটার গতি। এসময় “এই, এই তোমরা যাচ্ছ কোথায়?” কিছুটা বিরক্তির সাথে শোরগোল তুলে করা লাজু আর হেলেনের এই যুগপৎ প্রশ্নে পেছন ফিরে দেখার আগেই, চোখের সামনে ছুটন্ত দু’পুত্র দলছুট হয়ে দৌড়ে যেতে দেখলাম । লক্ষ দুজনেরই হোটেলের সেই বৃত্তাকার স্বয়ংক্রিয় সদর দরজাটি। কন্সিয়ার্জ ডেস্কের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা তাদের কাছে নিশ্চয় নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ মনে হয়েছে। তার চেয়ে বরং বাইরে গিয়ে, হোটেলে লাগোয়া যা নাকি হতে পারে হোটেলেরই অংশ, সেই ফেরারি গাড়ীর শো রুমটিতে গতরাতে দেখা হওয়া তাদের ফেরারি যুগলের হাল হকিকত জরীপ করাটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে ওদের।
ঘাড় ফিরিয়ে স্ত্রী আর বোনের উদ্দেশ্যে বললাম, থাক না, যাচ্ছে যাক না ওরা। কোথায় আর যাবে? খুব জোর ওদের দৌড় গেটের বাইরের ঐ ফেরারি গাড়ির শো রুম পর্যন্তই। আর তোমরা দু’জনও যাও না এগিয়ে । আমি এক্ষুণি কন্সিয়ার্জ ডেস্কের কাজ সেরে বাইরে আসছি গাড়িতে।
“হেই মিস্তার ইউর কার ইজ অলরেদি হিয়ার” ডেস্কের সামনে এসে হাজিরা দিতেই একগাল হাসিতে কিন্নর কণ্ঠে বলে উঠলেন মিস ইনা। পাল্টা হাসিতে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম যে, প্রথম কথা হল আমরা যে আজ তিয়েন আন মেন স্কয়ার দেখার পর, বেইজিঙয়ের পাখির বাসা মানে বার্ডস নেস্ট অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখতে যেতে চাই, তা যেন সে শোফারকে একটু ভাল করে বুঝিয়ে দেয়। আর তার আগে এক্ষুণি যেন সে চায়নিজ ভাষায় এই হোটেলের নাম ঠিকানা লেখা আছে এমন বেশ ক’টা কার্ড দেয় আমাকে। বলার সাথে সাথেই একমুঠো হোটেলের ঠিকানা লেখা কার্ড হাতে ধরিয়ে দিল মিস ইনা, সাথে বেশ পরিষ্কার চিংলিশে বলল যে শোফার কে বলে দেয়া আছে তার করনিয়। তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না মোটেও।
এদিকে কার্ডগুলোর দিকে নজর দিতেই দেখি, সবই লেখা ওখানে ইংরেজিতে ! কিছুটা হতাশ হয়ে তাই বলতে যাচ্ছিলাম, এ কি করলা কইন্না? চাইলাম চায়নিজ লেখা ঠিকানা, দিলা ইংলিশ। এ জিনিষ বাইরে কাউকে দেখালে তো কিছুই বুঝবে না কেউ, তাতে তো আমার কাজ হবে না। তবে ভাগ্যিস তা বলে ফেলিনি! বলার জন্য মুখ খোলার আগেই হাতের নাড়াচাড়ায় কার্ডের উল্টা পৃষ্ঠায় চোখে পড়তেই দেখি ওপাশটা ভরা আছে চায়নিজ লিপিতে। বুঝলাম এ হল একের ভেতরে দুই কার্ড। মানে একই কার্ডের এপাশে ইংরেজিতে হোটেলের ঠিকানা সাকিন লেখা আছে তো অন্যপাশে আছে তা চায়নিজে। আর যেরকম দ্রুততার সাথে কার্ডগুলো দিল মিস ইনা, তাতে বোঝা গেল বিদেশী যারাই আসে এখানে; হোটেল থেকে বেরুবার আগে তারা সবাই না হলেও অনেকেই এই কার্ডকে রক্ষা কবচ বানিয়ে সাথে নিয়ে বের হয়। ভাষা বিভ্রাটের এই দেশে এ বিদেশিদের জন্য চায়নিজে লেখা ঠিকানা একটি অতি দরকারি রক্ষাকবচ। এটি থাকলে সাথে পথ ভুলে হারিয়ে গেলেও, অন্তত কোন ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে তা দেখিয়ে সহজে ফিরতে পারবে ঠিকানামতো।
এইফাঁকে মিস ইনা দ্রুত আরো যা বলল তার মানে দাঁড়াল, গাড়ি ও শোফার নিয়ে কোন চিন্তারই অবকাশ নাই আমাদের। বেইজিং ট্যুরের জন্য অত্যন্ত অভিজ্ঞ আর ইংরেজি জানা ড্রাইভারই সে ঠিক করেছে। আমরা কিছু না বললেও সে ঠিকই সারাদিন আমাদের বেইজিং এর দর্শনিয় জায়গা গুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। তারপরও যদি কোন অসুবিধা হয়, তবে আমি যেন তাকে যে কোন সময় ফোন করতে দ্বিধা না করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদী পরিবারকে জানাই আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
পরবর্তী নিবন্ধআরো সমৃদ্ধ হোক দৈনিক আজাদীর পথচলা