১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর। দিনটি ছিল শুক্রবার। সরকারি ছুটির দিনে ৯৩ হাজার ৬২৬ টাকা কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে দেখিয়ে মোহাম্মদ আলম নামের এক ব্যক্তিকে নগরীর হালিশহর হাউজিং এস্টেটে সাড়ে চার কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নামে তা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ১৯৯০ সালের ওইদিনে প্রথম কিস্তি জমা দেওয়া হয়েছে দেখানোর প্রায় ২৮ বছর পর মোহাম্মদ আলমের পক্ষে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৬৭ টাকা (তন্মধ্যে সুদ ২ লক্ষ ৯ হাজার ৭২২ টাকা) জমা নিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার প্লটটি বরাদ্দ দেওয়ার চুড়ান্ত প্রস্তুতি নেয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেট। এরমধ্যে অফিসিয়ালি হস্তান্তর করা না হলেও বরাদ্দ গ্রহীতা মোহাম্মদ আলম প্লটটি ইতোমধ্যে সামসুউদ্দিন সুজন নামের এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তরও করেছেন। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সরকারি এ জমি নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দের মাধ্যমে পুরো প্লটটি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে খোদ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায় দুই বছর অনুসন্ধান চালিয়ে দেড় কোটি টাকার প্লট জালিয়াতির বিষয়ে সত্যতা পেয়ে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক লুৎফুল কবীর চন্দন দৈনিক আজাদীকে বলেন, হালিশহরে দেড় কোটি টাকার প্লট আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছে। অনুমোদন হয়ে এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি না হলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে ওই প্লটের তেমন মূল্য ছিল না। ধীরে ধীরে জায়গার দাম বেড়েছে। এ সুযোগে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নামমাত্র মূল্যে প্রায় দেড় কোটি টাকার মূল্যের জায়গাটি আত্মসাতের অভিযোগটির সত্যতা মিলেছে। প্লটটির ফাইলে রাখা ১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখের জমার সিটিআরটিও জাল।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের পটিয়ার উত্তর দেয়াং গ্রামের মৃত মো. ইউসুফের ছেলে মো. আলম শিকদার বাবুল ওরফে মো. বাবুল ১৯৯০ সালের ২৭ আগস্ট ওই প্লটের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে তিনি শুধু মো. আলম উল্লেখ করেন। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট ফাইলের নোটসিটের ১৯৯০ সালের ১৪ নভেম্বর ১নং নোটে ‘মো. আলমের নামে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে’ উল্লেখ করা হয়। ওই নোটের পর প্রথম কিস্তির টাকা জমা হয়েছে কিনা উল্লেখ করা না হলেও ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ পুনরায় কিস্তি জমা ও প্লট হস্তান্তরের আবেদন করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সামসুউদ্দিন সুজনের সাথে বায়না চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট মো. আলমের পক্ষে বেসিক ব্যাংক হালিশহর শাখায় ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৬৭ টাকার পে-অর্ডার জমা দেন সুজন। সবমিলিয়ে দুদক জানতে পারে, নথিতে ভুয়া চালান ও মিথ্যা সিটিআর যাচাই প্রতিবেদন সন্নিবেশ করত ওই চক্র ওই প্লটটি নামমাত্র মূল্যে আত্মসাতের পাঁয়তারা চালিয়েছেন। তবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অদ্যবধি প্লটের বাস্তব দখল রেজিস্ট্রি করে বরাদ্দগ্রহীতাকে বুঝিয়ে দেননি বলে দুদক জানতে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হালিশহর হাউজিংয়ের ফইল্যাতলী খালপাড় বাজারের সাথে লাগোয়া প্লটটির মধ্যে সেমিপাকা স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনাও প্রায় ১৫-২০ বছরের পুরোনো বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্লটটির সীমানা দেওয়ালে লেখা রয়েছে, ‘মো. আলম থেকে ক্রয়সূত্রে মালিক মোহাম্মদ সামসুউদ্দিন সুজন গং (সিক্স ব্রাদার্স)।
এদিকে অনুসন্ধানে দুদক জানতে পারে, ১৯৯০ সালে মোহাম্মদ আলমের নামে বরাদ্দ অনুমোদন হলেও ২০১১ সালের ২ মার্চ চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন মোল্লার স্বাক্ষরে ১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর জমা দেখানো ৯৩ হাজার ৬২৬ টাকার বিষয়ে সত্যতা জানতে চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কন্ট্রোল এন্ড একাউন্টস (ডিসিএ) বরাবরে চিঠি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৩০ জুন ডিসিএ অফিসের অডিট এন্ড একাউন্টস অফিসার নির্মল কান্তি চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। দুদকে উপস্থাপিত নথিতে ‘ডিসিএ কার্যালয় হতে চালানের সত্যতা ও টাকা জমা প্রদান করা হয়েছে’ মর্মে হাউজিং কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু দুদক কর্তৃক সংগৃহীত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর চালান নং এ/৯ মূলে কোন চালান কিংবা রেকর্ডপত্র জমা নেই মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃত বিষয়টি যাচাই করতে গত বছরের ২২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপককে (২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখের ছায়ালিপি সংযুক্ত করে) চিঠি দেয় দুদক। পরবর্তীতে ৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক হতে জানানো হয়, ১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে ৯৩ হাজার ৬২৬ টাকা মূলে চালানের সঠিকতা পাওয়া যায়নি। ‘উপস্থাপিত চালানের তারিখ ১৬/১১/১৯৯০ ছিল শুক্রবার (ছুটির দিন) পরিলক্ষিত হয়’ মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এরপর গত বছরের ১৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সিটিআর প্রতিবেদনের বিষয়ে ডিসিএ চট্টগ্রাম থেকে ‘উক্ত চালানটি (এ/৯, তারিখ- ১৬/১১/১৯৯০) জমার তথ্য চালান বহিতে লিপিবদ্ধ হিসেবে পাওয়া যায়নি, ওইদিন শুক্রবার, কাজেই উক্ত জমা সঠিক নহে’ বলে দুদককে জানানো হয়।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের ৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এস্টেট) মো. নাছির উদ্দিন স্বাক্ষরিত অফিসিয়াল পত্রে মোহাম্মদ আলমকে ‘মূল্য পরিশোধ দায়মুক্তির ছাড়পত্র’ দেন। ওই পত্রে হালিশহর আবাসিক এলাকার ‘এ’ ব্লকের ২নং লেইনের ২নং রোডের ০৬ নম্বর বাণিজ্যিক প্ল্টটি মোহাম্মদ আলমের নামে বরাদ্দপত্র জারি করা হয়। প্রত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘বরাদ্দ গ্রহীতা কিস্তির টাকা পরিশোধ করিয়াছেন। ডিভিশনাল কন্ট্রোলার অব একাউন্টস, চট্টগ্রামের স্মারক নং-১৬৭০, তাং- ৩০/০৬/২০১১ইং ও বেসিক ব্যাংক লি. ষোলশহর শাখা চট্টগ্রাম হতে ১৬/০৮/২০১৮ইং মাধ্যমে জমাকৃত টাকার সত্যতা স্বীকার করিয়াছেন। প্লটটির সমুদয় কিস্তির টাকা সুদসহ পরিশোধ করায় দায়মুক্তি ছাড়পত্র প্রদান করা হইল।’ পত্রের বর্ণিত ছকে ‘১৯৯০ সালের ১৬ নভেম্বর ১ম কিস্তির ৯৩ হাজার ৬২৬ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়।’ পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর পৃথক পত্রে মোহাম্মদ আলমকে প্লটটির দখল হস্তান্তর করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একই অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এস্টেট) মো. নাছির উদ্দিন। ওই চিঠিতেও বরাদ্দগ্রহীতা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনক্রমে কিস্তির টাকা পরিশোধ করিয়াছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন শনিবার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘হালিশহর হাউজিংয়ের এ ব্লকের ২নং রোডের ২নং লেইনের ৬নং প্লটটির বিষয়ে দুদকেও নথি রয়েছে, আমাদের কাছেও নথি রয়েছে। ১৯৯০ সালে ওই প্লটটি বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ আমার চাকুরি হয়েছে ২০১১ সালে, আমি চট্টগ্রামে এসেছি (পদায়ন) ২০১৫ সালে। প্লটটি আমি বরাদ্দ দিইনি। সবকিছু নথিতে উল্লেখ রয়েছে।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্লটটির বরাদ্দগ্রহীতা মোহাম্মদ আলমের খোঁজ না পেলেও ব্যাংক জমার স্লিপে উল্লেখ করা সামসুউদ্দিন সুজনের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘হাউজিং কর্তৃপক্ষের নথিপত্র দেখে মূল বরাদ্দগ্রহীতা মোহাম্মদ আলমের কাছ থেকে ২০১৮ সালে বায়নামূলে প্লটটির দখলে রয়েছি। মূলত আরিফ নামের এক ব্যক্তি ওই প্লট নিয়ে আমার কাছে চাঁদা দাবি করে ব্যর্থ হয়ে হাউজিংসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাকে হয়রানি করছে।’ দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে দুদকের কেউ ডাকায়নি। তবে মোহাম্মদ আলমকে দুদক ডাকিয়েছিল। ওইসময় আলম সাহেব প্লটটির যাবতীয় ডকুমেন্ট দুদককে দিয়েছিল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঈনুল হক মোতাইদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি এ অফিসে যোগদান করেছি বেশিদিন হয়নি। ওই প্লটটি সম্পর্কে আমরা তেমন ধারণা নেই।’ তিনি এ বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন।