ইমাম দরবেশের শহর বুখারা
বুখারা বিশ্বের বুকে আলোচিত পরিচিত নাম। মুসলমানগণের কাছে অন্যতম পবিত্র শহর। বুখারা বিশ্বে নিজের পরিচয়ে পরিচিত। যদিওবা উজবেকিস্তানে ৩য় বৃহত্তম শহর। বাংলাদেশের মানুষ ইমাম বুখারী (রহ.)’র জন্মস্থান, বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রহ.)’র জন্ম শায়িত বিধায় বুখারাকে সম্মানের চোখে মূল্যায়ন করে।
বুখারা খোরাসান অঞ্চলের অর্ন্তভুক্ত ছিল। বর্তমানে উজবেকিস্তানের একটি প্রদেশ। এ শহর জেরফসান নদীর তীরে অবস্থিত। বুখারার আশপাশ সমৃদ্ধ। এখানে নানান ফল, তুলা, রেশম উৎপাদিত হয়।
খ্রিস্টীয়পূর্ব ৫০০ অব্দে বুখারা গড়ে উঠে। অষ্টম শতকে আরবরা জয় করার আগেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীতে তাতারা সাম্রাজ্যের অধিকার গ্রহণ করে। ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান এসে শহরটি ধুলায় মিশিয়ে দেয়। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে উজবেক সম্রাটের রাজধানীতে পরিণত করে। অতঃপর এ বুখারা বিভিন্ন সময় মঙ্গোল, উজবেক ও তুর্কিরা শাসন করে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এ শহরের উপর রাশিয়ার লেলুপ দৃষ্টি পড়ে। ফলে এখানে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের রোষানলে মুসলমানের ধর্মপালন বন্ধ হয়ে যায়।
খলিফা আমিরে মুয়াবিয়ার আমলে খোরাশানের গভর্নর প্রথম মুসলিম অভিযান চালায়। এতে বুখারার নারী বাদশাহর সাথে এক সন্ধি চুক্তি হয়। খলিফা ওয়ালিদ এর শাসন আমলে বুখারাসহ খোরাশান অঞ্চলে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯০ হিজরিতে কুতাইবা ইবনে মুসলিম এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পুনঃ অভিযান চালায়। ৯৪ হিজরিতে শহরের দুর্গের ভিতর একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বুখারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে বুখারার শাসনভার গ্রহণ করে নাদির শাহ সাফাবি। অতঃপর বুখারার সম্রাট হিসেবে মুহাম্মদ রহিম অধিষ্ঠিত হন। তার সময়ে বুখারা মুসলমানগণের প্রধান অঞ্চলে পরিচিত হয়।
প্রায় শতের অধিক বছরের ব্যবধানে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রুশ শক্তির লেলুপ দৃষ্টি বাড়তে থাকে। ফলে বুখারাসহ এ অঞ্চলের অনেক ছোট বড় শহর রুশদের হাতে পতন ঘটে। এতে বুখারা অঞ্চলে রাশিয়া নিজের সদর দপ্তর স্থাপন করে। ফলে রুশদের দ্বারা বুখারার শাসন শুরু হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের মত রুশ সেনারা বুখারা নগরীতে তান্ডব লীলা চালায়। অতঃপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রুশ কমিউনিস্টদের হাতে বুখারার চূড়ান্ত পতন হয়। পরের বছর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ফলে মুসলমানগণের উপর দমন নিপীড়ন শুরু হয়। ধর্মপালন চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। রুশ কমিউনিস্টদের বর্বরতার ৭০ বছর পর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। বুখারাসহ উজবেকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বুখারা মহানগরীর প্রতিষ্ঠার ২৫০০ বছরের পুর্তি উদযাপিত হয়। এ পুর্তিকে সামনে রেখে এখানকার স্থাপত্য সংস্কারের কাজ চলে। তৎমধ্যে অট্টালিকা, নগর-দুর্গ, প্রাচীর, মিনার, প্রাসাদসহ প্রায় ১৪০ টি স্থাপনা সংস্কার করে সেগুলো সুরক্ষার নিশ্চিত করা হয়। অবশ্য তারও আগে UNESCO বুখারাকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের নগরী বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। যেহেতু এ শহরে ৭ শত এর অধিক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।
অর্থাৎ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর এ দেশের সমস্ত মাজার, মসজিদ, মিনার, স্থাপত্য সবকিছু নতুনভাবে সংস্কার ও সাজানোর কাজ শুরু হয়। যা ২/৩ দশক যাবৎ চলমান। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে এসেও অনেক সংস্কার চোখে পড়ছিল।
মূলতঃ বুখারা সমতল ভূমিতে সমৃদ্ধ এলাকা। দেশ অনুপাতে জনবসতি কম। ফলে প্রায় সব জায়গা খোলামেলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানকার মানুষ সুন্দর, ফর্সা, লম্বা, স্বাস্থ্যবান। মানুষ ধার্মিক, উদারপ্রণ, নম্র ও ভদ্র। পুরাতন বুখারা ইমাম বোখারী (রহ.)’র জন্ম। ৬/৭ শত মিটারের ব্যবধানে তাঁর মসজিদ, মাদ্রাসা। ইমাম বুখারী মসজিদের মিনার মধ্য এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার হিসেবে স্বীকৃত। সম্রাট মুহাম্মদ আট সালাম খান এ মসজিদ, মিনার, মাদ্রাসা পুনঃ নির্মাণ করেন।
বুখারা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ইমাম আবু খফ্স কবিরের মাজার। তিনি হানাফী মাজহাবের বিশ্বখ্যাত ফকিহ। ইমাম আবু হানিফার ছাত্র, ইমাম বুখারীর ওস্তাদ। বুখারা নগরীর উপকণ্ঠে ইমাম বাহাউদ্দিন (রহ.)’র মাজার কমপ্লেঙ। বুহত্তর বুখারায় ১৫-২০ জন ইমাম, অলি, দরবেশ শায়িত। গত ২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে আমার বুখারা গমন করার সৌভাগ্য হয়। সাথে উজবেকিস্তানের সমরকন্দ, তেরমেজ (তিরমিজি) এবং রাজধানী তাশখন্দও।
৩০ অক্টোবর দিবাগত রাত উজবেক এয়ারে আড়াই ঘণ্টার যাত্রায় দিল্লি থেকে তাশখন্দ যাওয়া হয়। তাশখন্দ থেকে সকালের ট্রেনে বুখারা। প্রায় ৬ শ’ কিলোমিটারের মত দূরত্বে মাত্র ৫ ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছিয়ে দেয় উন্নতমানের ট্রেনে। দুপুরে বুখারা পৌঁছে পর পর ৩ রাত থাকা হয়েছিল। এতে হযরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রহ.) ও হযরত আবু খফ্স কবির (রহ.) সহ একাধিক ইমাম অলি দরবেশের যেয়ারত করা হয়। সহীহ হাদীস সংকলক হযরত ইমাম বুখারী (রহ.)’র জন্মস্থান এ বুখারায়। জন্মস্থান থেকে মাত্র আধা কি.মি ব্যবধানে বিশ্বখ্যাত মাদ্রাসা ও মসজিদ, যেখানে তিনি পাঠদান করতেন। ইমাম বুখারী মসজিদের মিনার মধ্য এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার হিসেবে স্বীকৃত। বুখারা থেকে সমরকন্দ আসা হয়। বিশ্বের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে সমরকন্দ অন্যতম।
এ শহরের ইতিহাস অতী সমৃদ্ধ। শহর থেকে মাত্র ১০/১২ কি.মি ব্যবধানে ইমাম বুখারী (রহ.) শায়িত। সমরকন্দে ২ রাত থেকে যাওয়া হয় আফগানিস্তানের সীমান্ত শহর তেরমেজে (তিরমিজ)। অপর সহীহ হাদীস সংকলক ইমাম তিরমিজী (রহ.)’র এ শহরের ২০/৩০ কি.মি দূরত্বে শায়িত। উভয় সহীহ হাদীস শরীফ সংকলকের যেয়ারত করার সৌভাগ্য হয়। তেরমেজ থেকে আকাশপথে তাশখন্দ আসা হয়। অতঃপর তাশখন্দ থেকে আকাশপথে দিল্লি আসা। উজবেকিস্তানে অনেক ইমাম অলি দরবেশ শায়িত। তবে আধ্যাত্মিক তথা তরিকতের সিলসিলার মধ্যে নক্শবন্দীয়া সিলসিলার অনেক ইমাম সুফি দরবেশ এ উজবেকিস্তানে শায়িত রয়েছেন। ফলে অনেক লেখক গবেষক উজবেকিস্তানকে নক্শবন্দীয়ার জমিন বলেছেন। দিল্লি থেকে তাশখন্দের দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। কিন্তু তাপমাত্রা অনেক অনেক ব্যবধান। যেখানে দিল্লিতে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর উপরে, সেখানে তাশখন্দ বুখারা সমরকন্দের তাপমাত্রা মাত্র ৩/৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা আরও নিচে। ফলে কনকনে ঠান্ডা। এতে আমরা অন্যভস্ত বাংলাদেশী যেয়ারতকারীর জন্য হঠাৎ করে ঠান্ডার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া খুব কষ্ট হচ্ছিল। বস্তুত বুখারা যেমনি বিশ্বের আলোচিত শহর তেমনি ইমাম বুখারী, বাহাউদ্দিন নক্শবন্দসহ আরও অলি দরবেশ এবং বিভিন্ন ইসলামী স্থাপত্য নিয়ে গর্বিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট