সিআরবি : মরুভূমির বুকে এক টুকরো ‘মরুদ্যান’

সালমা বিনতে শফিক | মঙ্গলবার , ২৭ জুলাই, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

আমার স্কুলজীবনের এক বান্ধবী থাকে কানাডার থান্ডার বে নামক এক ছিমছাম শহরে। সেদিন একটা ছবি পাঠিয়েছে স্কুলবন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে; ওর উঠোনে চরে বেড়াচ্ছে এক বাচ্চা হরিণ। না, হরিণটা ওর পোষা নয়। জঙ্গলেই থাকে, যখন-তখন লোকালয়ে চলে আসে। চোখ দেখে বোঝা যায় ভয়ডর কিচ্ছু নেই। সেদেশের মানুষতো ওদের ধরে বেঁধে খেয়ে ফেলে না। তবে সুযোগ পেলে দু’চার জনে যে খেয়ে ফেলত না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুযোগ যেহেতু নেই, বনের পশুপাখিরা অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় মানুষের আশেপাশে। রাজহাঁসের পাল বনেদি চালে ঘুরে বেড়ায় জনঅরণ্যে, হংসমাতা ছানা পোনাদের নিয়ে হেলেদুলে পাড়ি দেয় রাজপথ। যত তাড়াই থাক, কোন গাড়ির সাধ্য নেই, সাহস নেই (ইচ্ছেও নেই) ওদের চাপা দিয়ে ছুটে পালায়। বনরক্ষায়, বনের পশু পাখিদের জীবন রক্ষায় রাষ্ট্রীয় আইন বড়ই কড়া।
একটুখানি মাথাটা খাটালেই বোঝা যায় প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে জীবনযাপনের যে ধারা পশ্চিমা দেশগুলোতে চলছে, তার জন্য রাশি-রাশি টাকাকড়ির প্রয়োজন নেই। বরং আমার দেশে প্রকৃতিকে নিঃস্ব করে, রিক্ত করে, নগ্ন করে একের পর এক যেসব উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে, তার পেছনেই নিঃশেষ হচ্ছে টাকা, জলের মতো করে, যদিও বরাদ্দ অর্থের বড় অংশই থেকে যায় অব্যবহৃত, অপ্রদর্শিত। আরও পরিতাপের বিষয় এই যে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ায় যত উৎসাহ, পুরনো স্থাপনার যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণে তার ছিটেফোঁটাও নেই আমাদের মাঝে। তাই শত কোটি টাকার স্থাপনায় ফাটল ধরে, বহুমূল্যের যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। এসবতো আজকের কথা নয়। যুগ-যুগ ধরে দুর্নীতিকে সঙ্গী করেই আমাদের এই পথচলা। সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের মানুষদেরকে ক্রমাগত অমানবিক করে তুলছে, সন্দেহ নেই। আর্থিক লাভালাভই হয়ে পড়েছে আমাদের একমাত্র মোক্ষ। ইতিহাস বলে, বিজ্ঞানও সাক্ষ্য দেয়- সাড়ে চার বিলিয়ন বছর বয়সী এই পৃথিবীতে মানববসতি শুরু হয় ছয় মিলিয়ন বছর আগে, যদিও সেকালের মানুষরা আমাদের মতো ‘জ্ঞানী’ ছিল না। সেদিন থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষরা একটু-একটু করে প্রকৃতিকে গ্রাস করতে শুরু করে। তখন অন্য কোনো উপায় ছিল না গ্রাসাচ্ছাদনের। বনের পশুদের মতো পেটটা ভরা থাকলেই চলে যেত তাদের। পশুরা কিন্তু প্রকৃতির কোনো ক্ষতি করেনি, আজও করে না। আস্তে আস্তে চাহিদা বাড়ে মানুষের, বাড়ে স্বপ্ন। মানুষ সংগ্রহ করা শেখে, জমানো শেখে, ফসল ফলাতে শেখে। ক্রমান্বয়ে ঘরবাড়ি, ধর্মালয়, বিদ্যালয়, পথঘাট কত কী যে দরকার হয় মানুষদের ! পান্থনিবাস, সরাইখানা নির্মিত হয়। নির্মিত হয় চিকিৎসালয়। প্রাসাদ, প্রমোদকেন্দ্র, বিপণী ও সৌন্দর্য্য চর্চাকেন্দ্র যোগ হয় নগরে-নগরে। প্রতিটি স্থাপনার জন্যই একটু একটু করে ধ্বংস করতে হয় প্রকৃতির কোনো না কোনো আশীর্বাদকে। পাহাড় কেটে, বনভুমি উজাড় করে, জলাশয় ভরাট করে মানুষের একের পর এক সৌধ নির্মাণের এই প্রক্রিয়ার শুরু প্রাগৈতিহাসিক কাল হতেই। সেকালে মানুষ আজকের মতো শিক্ষিত ছিল না, তাই অত বুদ্ধিও ছিল না ঘটে। বনভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান ছিলনা তাদের। নির্বিচারে জঙ্গল-পাহাড় কেটে নিজেদের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নিয়েছিল। তবে প্রকৃতিকে ভক্ষণ করে আখের গোছানোর মতো ব্যবসায়িক মনোবিকৃতির উদ্ভাবন ও বিস্তার সেকালে ঘটেনি।
একালেও কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোতে এমন দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। একশ নব্বই বছরের ইংরেজ অপশাসন আর চব্বিশ বছরের পাক নিষ্পেষণ থেকে অনেক রক্ত দিয়ে মুক্তি মিললেও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অবস্থানে আমরা পৌঁছুতে পারিনি বিগত অর্ধশতকে। অর্ধশতক অবশ্য খুব বেশি সময় নয়। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী নীরবে কেঁদে গিয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের পর প্রায় শতবছর। অতঃপর এসেছিল সুদিন। তাই হতাশ হইনা। আমাদের প্রাণের বাংলাদেশেও একদিন সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেদিন হয়তো আমরা থাকব না। আমাদের আত্মজরা দেখবে নতুন আলোর সূর্যোদয়।
কিন্তু কোথায় রচিত হবে আমাদের সন্তানদের স্বপ্নের ঠিকানা? আমাদের পাহাড়-নদী-অরণ্য হারিয়ে গেলে আমাদের সন্তানরা যে শ্বাসটুকুও নিতে পারবে না। ‘হারিয়ে গেলে’ বলছি কেন, বেশীর ভাগইতো হারিয়ে গিয়েছে। বঙ্গজননীর শিরায়-শিরায় বয়ে যাওয়া শত নদী মরে গিয়ে কপাল খুলে দিয়েছে ভুমিদস্যুদের। আমরা কিছুই করতে পারিনি। বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নেওয়া সুন্দরবনকেও আমরা উৎসর্গ করে দিয়েছি উন্নয়নের নামে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্য ও নৈসর্গিকতা বিপন্ন পর্যটনের নামে। উন্নত বিশ্বে শহরের মাঝে গ্রাম বাঁচিয়ে রাখার জন্য কি প্রাণান্তকর চেষ্টা! আমাদের জনপ্রতিনিধিগণ গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখান মাটির মানুষদের। সব কুঁড়েঘর ভেঙে দালান কোঠায় উঠে যাচ্ছে গাঁয়ের হতদরিদ্র প্রান্তজন। ধানি জমিতে ধাঁই ধাঁই করে নির্মিত হচ্ছে কারখানা। পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে চোখের পলকে। অচিরেই নির্মিত হবে বৃহৎ কোন স্থাপনা।
আমরা দেখেও দেখিনা- ওদের বাড়িতে সামনে পেছনে উঠোন থাকে। গাছ গাছালি ভরা বাগান থাকে। ভোরসকালে মোরগ ডাকে – কুক্কুরুক কুক। উঁচু পাঁচিল নয়, নিচু বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিমছাম সীমানা। দিবারাত্র দ্বাররক্ষী দণ্ডায়মান থাকে না ওদের বাড়ির ফটকের সামনে। ঝলমলে রাজকীয় নয়, ছোট্ট কাঠের ফটক। একপাশে পাখির বাসার মতো চিঠির বাঙ, অন্যপাশে পরিষ্কার করে লেখা- বি ড়ঢ়ঢ়ড়ংব রহধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ (আমরা অসঙ্গত উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করি)। পশ্চিমারা নগর সাজায় গ্রামের মতো করে। অথচ তাদের অনুকরণ করতে গিয়ে হাজার বছরের অপরূপা পল্লী গাঁ-কে আমরা বিষাক্ত শহর বানিয়ে ফেলছি।
বছর সাতেক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে কাটিয়ে দেশে ফেরার সময় মেয়ের বাবাকে বলেছিলাম- দালান কোঠা চাইনা আমার, ছোট্ট একটা বাড়ি, সঙ্গে এক চিলতে উঠোন হলেই চলবে। এই শহরে উঠোন! এ যে এতোটা দুষ্প্রাপ্য দেশে পা রেখেই তা বোঝা গেল। এক খণ্ড জমি কিনে খোলামেলা উঠোনঘেরা একটা বাড়ি আর আমার হল না। বহুতল অট্টালিকার খাঁচাতেই পাততে হল ঘরকন্যা। কারণ শহুরে নাগরিকদের জন্য এটাই এখন সবচেয়ে সহজ উপায় ঘর বাঁধার। তবে ঝঞ্জাটবিহীন, তা বলা চলে না। ঘর আছে তাই ঢের, খাঁচা বলার আস্পর্ধা দেখানো হয়তো সাজে না। কিন্তু এই শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলো এমন করে গায়ে গায়ে লেগে থাকে যে জানালা খোলার উপায় নেই, খুললেও বাতাস ঢোকার পথ নেই ঘরে, কারণ পর্দা আটকে রাখতে হয় টানটান করে, নিজস্ব ভুবনটা একান্তে রাখার প্রয়োজনে। এক হাত চওড়া বারান্দায় চেয়ার পেতে বই হাতে বসা দূরে থাক, দুদণ্ড দাঁড়ানোর সুযোগও নেই। একে খাঁচা না বলে উপায় কি? গগনবিদারী বিচিত্র শব্দের উৎপাতের কথা কি আর বলবো!
এই খাঁচাবদ্ধ নাগরিকদের প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার মতো একটা জায়গা তো চাই, যেখানে হাত পা নেড়ে স্বস্তিতে দুকদম হাঁটা যায়, প্রাণের মানুষদের সঙ্গে মন খুলে দুটো কথা বলা যায়, গানের কলি ভাজা যায় গুনগুনিয়ে কিংবা মন চাইলে গলা খুলে গেয়েও উঠা যায়; চরাচরে প্রতিধ্বনিত হয় সংগীতের মূর্চ্ছনা। প্রাচ্যের রানী, তিলোত্তমা চট্টলায় এমন একটি স্থানই বেঁচে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। চট্টগ্রাম রেলওয়ের আওতাধীন উন্মুক্ত সিআরবি; ঠিক যেন মরুভূমির বুকে এক টুকরো ‘মরুদ্যান’। এই শহরের এক চিলতে উঠোন। আর সব কবেই হাওয়া হয়ে চলে গিয়েছে দুর্বৃত্তদের পেটে! কিন্তু উন্মুক্ত স্থানকে আমজনতার অবাধ বিচরণের জন্য ছেড়ে দেওয়া আমাদের ধাতে নেই। হাসপাতাল নির্মাণ করে জনসেবার বাহানা তুলে গ্রাস করে নিতে চায় নগরীর ফুসফুসটাকেও।
ইংরেজ দুশো বছরের মতো শোষণ করলেও শহরটাকে সাজিয়ে দিয়েছিল নিজেদের সুবিধেমতো, রুচিমতো। ওদের কাজে ফাঁকি ছিল না, ভেজাল ছিল না। হয়তো ভেবেছিল এ-তল্লাটে চিরকাল থেকে যাবে ওরা। উদ্দেশ্য ওদের যাই থাকুক, আমরা পেয়েছিলাম ছবির মতো সাজানো একটা শহর। থান্ডার বে শহরের সব উপাদানই ছিল এই শহরে। ছেলেবেলায় আমবাগান রেলওয়ে কলোনিতে বড়খালার বাসায় বেড়াতে যাবার সময় মনে হতো- বিদেশে যাচ্ছি; কি পরিকল্পিত ছিমছাম একটা শহর! কোন কিছুর কমতি নেই। নেই কোথাও বাড়াবাড়ি। কর্ণফুলী সাক্ষী তিন দশকে খোলনলচে পাল্টে ফেলে এক অবরুদ্ধ, বিষাক্ত, জলাবদ্ধ শহরের রূপ ধারণ করেছে রূপসী চট্টলা, বীরপ্রসবিনী চট্টলা। সবুজ পাহাড় নয়, দু’পা যেতেই চোখে পড়ে আবর্জনার পাহাড়। নগর অধিপতিদের অব্যবস্থাপনাই নয়, শহুরে নাগরিকদের দায়ও কম নয় এই বর্জ্য পর্বত সৃষ্টিতে।
তবে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কিছুদিন আগেও মনে হত এই শহরটাকে দেখার কেউ নেই, কেউ ভালবাসে না প্রাণের চট্টগ্রামকে। সিআরবি রক্ষার জন্য মানুষ কোভিডের ভয় পেছনে ফেলে যেভাবে পথে নেমেছে তা দেখে মনে হয় শহরের ফুসফুস রক্ষায় প্রাণ দিতেও তৈরি তারা। এ-লড়াই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এমন গণজোয়ার অনেকদিন দেখেনি বাংলাদেশ। পথে নামা মানুষগুলো নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়, গান শোনায় নতুন সূর্যোদয়ের। কবিগুরুর বাণী ধার করে অভিবাদন জানাতে চাই নতুন দিনের আলোর যোদ্ধাদের ‘মুক্ত কর ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিও কঠিনও পরিচয়।’
ড. সালমা বিনতে শফিক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু, রেকর্ড শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধএসএসসি ও এইচএসসিতে এবার ৩ বিষয়ে পরীক্ষা