‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’

শ্রদ্ধাঞ্জলি

রীতা দত্ত | সোমবার , ১৯ জুলাই, ২০২১ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

১০ জুলাই চলে গেলেন আমাদের প্রিয় দাদামণি অরুণ দাশগুপ্ত। সব লেনদেন চুকিয়ে, কর্ম সাঙ্গ করে শান্তির পারাবারে তরী ভাসালেন। “যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা, নয়নে আঁধার রবে ধেয়ানে আলোক রেখা।” প্রীতিভাজন রাশেদ রউফের পোস্ট থেকে জেনেছিলাম ৯ জুলাই দৈনিক ভোরের কাগজ দাদামণির উপর বিশেষ সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছে। পরদিন আমি একটা কপি কিনে অরুণদাকে নিয়ে লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম, সে সময় ধলঘাট থেকে খবর পেলাম দাদামণি আর নেই। খুব কষ্ট পেলাম। গত কয়েক মাস থেকে দাদামণি অসুস্থ। রহমতগঞ্জস্থ যোগেশ ভবন থেকে ঘাটফরহাদবেগ মিহির কানুনগো’র বাসায় আছেন, দেখতে গেলাম। কিছুদিন পর শুনলাম স্থানীয় একটি ক্লিনিকে আছেন, আবারও গেলাম শারীরিক অবস্থা কেমন আছে জানতে। এর পর চলে গেলেন শেকড়ের টানে নিজ বাসভূমে চট্টগ্রামের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ‘ধলঘাট’ গ্রামে। করোনার ভয়াবহতা সময়ে ধলঘাট গিয়ে দাদামণিকে দেখতে যেতে পারি নি। ধলঘাটের প্রীতিলতা ট্রাস্ট থেকে দাদামণিকে সংবর্ধনা জানানো হবে, পঙ্কজ চক্রবর্তী (ট্রাস্টের সভাপতি) বার বার ফোন করছে যাবার জন্য কিন্তু সবার নিষেধ উপেক্ষা করতে পারি নি গেলাম না। তখন ভাবছি “হায়, ওরে মানবহৃদয়, বার বার কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই কো সময়।” প্রতিবেশী একটা পরিবার সেবাযত্ন করছে। বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক অরুণদা কিন্ত চলনে বলনে পোশাকে আশাকে নেই কোন আতিশয্য, নেই কোন গরিমা। থাকবেই বা কেন, তিনি যে চিত্তের সম্পদে বৈভবে সমৃদ্ধ। কারো জন্য কোন অণুযোগ করতে কখনো শুনি নি।
সত্তর দশকের শেষদিকে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ। বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জেন ডা. কেশব সেন এর দোতলা বাড়িতে আমাদের অপর্ণাচরণ স্কুলের কল্যানী দিদিমণি (ডা. কেশব সেন এর কন্যা) এবং তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু বড়দিমিণি (প্রণতি সেন) থাকতেন। বড়দিদিমণির সাথে আত্মীয়তার সূত্রে টুলু (ত্রিদিব চৌধুরী, রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলনীর চট্টগ্রামের সম্পাদক) এবং অরুণ দা ঐ বাড়িতে নীচতলায় থাকতেন। প্রাণের টানে দিদিমণির বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। একদিন অরুণ দার সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি তখন দৈনিক আজাদীতে সাহিত্য সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন। জীবনের প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত তিনি আজাদী পরিবারের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন শ্রদ্ধার আসনে। নিয়ম মাফিক অবসরে গেলেও তিনি নিয়মিত অফিসে আসতেন, সাহিত্যের পাতা দেখতেন সম্পাদক এম এ মালেক সাহেবের আগ্রহে। দাদামণি সাহিত্য, সংস্কৃতিপ্রেমী একজন মানুষ, দাদামণির কাছে চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের নবীন প্রবীণ অনেকে আসতেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে আলাপ হতো, সৃজনশীল আড্ডা জমত। ধীরে ধীরে তাঁর সম্পর্কে অনেক বিষয় অবগত হলাম। এমন সদালাপী, স্থিতধী, জ্ঞানঋদ্ধ, পরোপকারী, সকলকে পরম আন্তরিকতায় কাছে টেনে নেয়ার মতন মানুষ কম দেখেছি। তাঁর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে বসার সুযোগ হয়েছে। তাঁর আলোচনা শুনে মুগ্ধ হতাম, বিস্মিত হতাম এত বিচিত্রতর বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি জেনে। আমি তাঁর লেখার একজন নিষ্ঠপাঠক, উপকৃত হয়েছি অনেক। বৌদ্ধ মন্দির সড়কে “কল্যাণী ফ্ল্যাট” এ টুলু জীবিত থাকাকালিন রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলনের বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য গানের মহড়া হোত। উপস্থিত থাকতেন অরুণদা, ড. অনুপম সেন, ড. মাহবুবুল হক, ড. ইফতেখার উদ্দিন, প্রয়াত ওস্তাদ মিহির নন্দী এবং আমি সহ আরো অনেকে। অরুণদাকে প্রায়শ শিল্পীদের গানের সুর, উচ্চারণ শুদ্ধ করে দিতে দেখেছি। রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর তাঁর এত দখল! জেনেছি তিনি কোলকাতায় থাকাকালীন রবীন্দ্রসঙ্গীতের খ্যাতিমান শিক্ষকদের কাছ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন বেশ কয়েক বছর। ২০১৭ তে প্রকাশিত তাঁর লেখা “রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ” বইটি রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার জন্য একটি আকর গ্রন্থ বলে মনে করি। বইটি দাদামণি আমাকে আশীর্বাদস্বরূপ উপহার দিয়েছেন। এই আমার অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ষড়ঋতুর বন্দনা কথা সর্বজনবিদিত। প্রতিটি ঋতু রবীন্দ্রনাথের কাছে অপরূপ শোভায় ধরা দিয়েছে, মানুষের মনোজগতের সাথে সাযুজ্য রেখে যেন প্রতিটি ঋতুর আগমন। অরুণ দা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের গানের বিশেষত্ব হোল সুর প্রয়োগের কৌশল। সুরের প্রয়োগ নৈপুণ্যে চমক যতটা নেই তার চেয়ে বেশি রয়েছে চমৎকারিত্ব। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পীদের রেওয়াজ নিত্য দিনের সঙ্গী হতে হয়।” তাঁর আগ্রহে আমি দুটি স্মারক প্রবন্ধ লিখেছি। দাদামণির মূল্যবান পরামর্শে – একটি চট্টল গৌরব বিশিষ্ট গবেষক আবদুল হক চৌধুরী’র উপর অন্যটি রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলনের বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য “রবীন্দ্র জীবন দর্শন” এ শিরোনামে। প্রবন্ধ দুটি অনুষ্ঠানে আমি পাঠ করেছিলাম। দাদামণির মনঃপুত হয়েছিল জেনে খুশি হয়েছিলাম।
১০জুলাই সন্ধ্যায় আমরা যখন উপাসনালয়ে দাদামণির জন্য শান্তিমন্ত্র পাঠ করছিলাম তখন ধলঘাট থেকে খবর এল দাদামণির স্থুল নিথর দেহটি শ্মশানে তুলে দেওয়া হয়েছে। খুব খারাপ লাগলো। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘যখন ছিলেম অন্ধ’ এর কথাগুলো “যে দিন তুমি অগ্নিবেশে সব কিছু মোর নিলে এসে, সেদিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল সব দ্বন্দ্ব, দুঃখ সুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ।” দাদামণি পূর্ণ হলেন, আমরা বেদনাহত হলাম। দাদামণি, জানি, আপনি আপনার প্রিয়জনদের মাঝে থাকবেন, নিরন্তর সুধারস ঢালবেন। দাদামণির জন্য অশেষ শ্রদ্ধা প্রণতি।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি চারুকলা কলেজ চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিত্রাণের পথ ওই একটাই
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়