করোনা সংক্রমণের চলতি গতি-প্রকৃতি দেখে সামনে করুণ অবস্থার শঙ্কা প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরই মধ্যে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কোরবানি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে আট দিনের জন্য লকডাউন শিথিল করেছে সরকার। কোরবানির ঈদের কারণে লকডাউন তুলে নেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। গত ১৫ জুলাই দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে, এই বিধি-নিষেধ শিথিল করা সাপেক্ষে আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এদিকে, করোনার সংক্রমণ দ্রুত ছড়ানো ডেল্টা ধরনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বজুড়ে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে এবং আমরা বর্তমানে এর প্রাথমিক পর্যায়ে আছি।’ তিনি বলেন, ‘টানা চার সপ্তাহ ধরে বিশ্বে করোনায় দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই ভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরন ডেল্টা ইতেমধ্যে ১১১টি দেশে শনাক্ত হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।’ কাজের সুবিধার জন্য বিশ্বের দেশসমূহকে ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রশাসনিক অঞ্চল ব্যতীত বাকি পাঁচ অঞ্চলেই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। তিনি বলেন, ‘শুধু টিকার মাধ্যমে এই তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলা করা যাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টা ধরন টিকার ডোজকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এ কারণে শুধু টিকার ওপর নির্ভর করে থাকলে এই তৃতীয় ঢেউকে ঠেকানো সম্ভব হবে না।’ এ জন্য যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন বলে বলে তিনি জানান।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভারতে উদ্ভূত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্থানীয় সংক্রমণ ঘটার পর গত মার্চের শেষ ভাগ থেকে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন গত ১১ জুলাই বলেছিলেন, সংক্রমণ এখনও বেড়েই চলেছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালের সমস্ত খালি বেড পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে। তখন সবাই মিলে বিপদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে। সেই এক সপ্তাহের মধ্যেই ১৫ জুলাই থেকে নয় দিনের জন্য মহামারীর সব ধরনের বিধি-নিষেধ তুলে নিয়েছে সরকার। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি লকডাউন তুলে নেওয়ার বিপক্ষে ছিল। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ একদিন আগে বলেন, লকডাউনটা এভাবে উঠিয়ে দেওয়ার কারণে সবাই তো আবারও রাস্তাঘাটে বেরুবে, অফিস-আদালতে যাবে, গণপরিবহনে চড়বে, বাজারে যাবে। সব মিলিয়ে তো যত বেশি মানুষের মেলামেশা হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে না, সংক্রমণ তত বেশি বেড়ে যাবে। সেজন্য ঝুঁকিটা তো থেকেই যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণের হার কমাতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সংক্রমণের হার না কমলে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে, স্বাস্থ্যসেবায় বিরাট চাপ পড়বে। আমাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবে। বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়বে। যে সব কারণে সংক্রমণ বাড়ে, সেসব কারণ বুঝে চলতে হবে আমাদের। বিশেষ করে, এ সময়ে পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রে গমন ও জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন- বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিহার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় সংক্রমণের লাগাম টানা সম্ভব নয়। যদি সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।