দিন তিনেক আগে দৈনিক আজাদীতে একটি ছবি ছাপানো হয়। করোনার টিকা পরিবহন করা হচ্ছিল সিএনজি টেক্সিতে। টেক্সির পেছনে এবং পাশে বাক্সভর্তি করে টিকা বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এত কাঙ্ক্ষিত এবং মূল্যবান টিকা পরিবহনের মতো একটি গাড়ি ছিল না বলেই হয়তো স্বাস্থ্যকর্মী অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে টেক্সির বাইরে ঝুলিয়ে টিকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই ছবিটিতেই চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতের দারুণ এক চিত্র ফুটে উঠে। গত বছর থেকে শুরু হওয়া করোনাকালে চট্টগ্রামে অসংখ্য মানুষ শুধু একটু অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে দিশেহারা অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশায় শিল্পপতি থেকে সাধারণ মানুষ অকাতরে মারা পড়েছে। করোনার ভয়াবহ বিস্তারে চট্টগ্রামের বহু মানুষ এখনো সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু করোনার ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য অসুখের চিকিৎসার সুযোগ থেকেও সাধারণ মানুষ বহু দূরে।
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতের এমন বেহাল দশার মাঝে ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের ৫০০ বেডের হাসপাতাল এবং ১০০ ছাত্রছাত্রী পড়ার মতো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা অথৈ সাগরে ডুবে যাওয়া মানুষের হাতে লাইফ জ্যাকেট উঠে আসার মতো আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করার কথা ছিল। মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে তাদের স্বাগত জানানোর কথা। কিন্তু তা হয়নি। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) সিআরবি এলাকায় ছয় একর জায়গার উপর এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। নিজেদের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকু হারিয়ে ফেলার আতংকে লাখো মানুষ। করোনাকালে শ্বাস নিতে না পেরে বালিশ চাপা দেয়া অবস্থার মতো শ্বাস কষ্টে ভুগছে চট্টগ্রামের অনেক মানুষ। তারা সেই কষ্ট হজম করতে রাজি, তবু সিআরবির মতো জায়গাটি কোনো কর্পোরেট গ্রুপের বেসাতির জন্য ছেড়ে দিতে রাজি নয়। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। তারা তাকিয়ে আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে। আমরাও তাকিয়ে আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনুগ্রহ করে, চট্টগ্রামের মানুষকে শ্বাস নিতে দিন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মতো প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর শহর পৃথিবীতে খুব কমই ছিল। সাগর, নদী এবং পাহাড় ঘেরা এই শহরটি ছিল সবুজে ঢাকা। ছায়াঢাকা পাখি ডাকা এই শহরটির ভিতরে অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় মনোরম এক নান্দনিকতা ছড়াতো। চট্টগ্রাম নগরীতে এসে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় ছিল না। দেশি-বিদেশি মানুষ এই শহরে এসে মুগ্ধ হতো। পাহাড় এবং সবুজে সবুজে একাকার শহরটি দেখে হিউয়েং সাং-এর মতো বিশ্বখ্যাত পর্যটক শহরটিকে প্রাচ্যের রাণী আখ্যা দিয়েছিলেন। শহরের সেই রূপ এখন আর অবশিষ্ট নেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দিনে দিনে নানামুখী অনাচার এবং অত্যাচারে আমাদের প্রকৃতি হারিয়ে গেছে, পাহাড় সাবাড় হয়েছে, খাল নদী দখল হয়েছে। বেদখল হয়েছে আমাদের বহু ইতিহাস আর ঐতিহ্য। বর্ষায় এখন শহরটি পানিতে ডুবে, থৈ থৈ করে।
পৃথিবীর সব শহরেই একটি সেন্ট্রাল এরিয়া থাকে। যেখানে মানুষ প্রাণভরে শ্বাস নেয়। অবসরে একটু সময় কাটায়, নিজেদের মতো করে পার করে কিছু সময়। চট্টগ্রামের ডিসি হিল, আউটার স্টেডিয়াম কিংবা সার্কিট হাউজের সামনের এলাকায় মানুষ অবসরে সময় কাটাতো। কিন্তু চট্টগ্রামের সেই জায়গাগুলোও শেষ করে দেয়া হয়েছে। ডিসি হিলে প্রবেশাধিকার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। আউটার স্টেডিয়ামে এখন আর খেলাধুলা হয় না, পানি থৈ থৈ করে। নানা ধরনের বেসাতি চলে আউটার স্টেডিয়ামজুড়ে। অগুনতি দোকানপাটে গিঞ্জি এক এলাকায় পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের আপামর মানুষের প্রাণের এই জায়গাটি। সার্কিট হাউজের সামনের জায়গাটিকে ঘিরে ফেলা হয়েছে পার্কের নামে। সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার পুরোটাই টিকেট নির্ভর।
নগরজুড়ে এই শূণ্যতার মাঝে চট্টগ্রামের মানুষের একমাত্র অবলম্বন এখন সিআরবি। বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তরের এই জায়গাটি শত শত গাছগাছালিতে ভরা। মনোরম ছোট্ট পাহাড়ি এলাকাটিতে শতবর্ষী গাছের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। এগুলো মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। শহরের অন্য যে কোনো এলাকা থেকে সিআরবির তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম থাকে। তীব্র গরমে মানুষ এখানকার শতবর্ষী গাছের তলায় শুয়ে বসে সময় কাটায়, গল্প করে। ভোর থেকে রাত অব্দি মানুষের নানামুখী কার্যক্রম চলে এলাকাটিতে। কেউ শরীর চর্চা করে, কেউবা গল্প করে। শিশু কিশোরেরা ক্রিকেট ফুটবল খেলে। ফুচকা চটপটি, ঝালমুড়ি খেয়ে কিংবা বাদামোর খোসা ছড়াতে ছড়াতে স্বপ্ন বুনে তরুণ-তরুণীর দল। চট্টগ্রামে মানুষের কাছে প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার জায়গা সিআরবি হয়ে উঠেছে একটি আবেগের নাম। শতবর্ষী গাছ কাটা বা না কাটাতেই ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এটি চট্টগ্রামের মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই এই জায়গাটি রক্ষা করতে ফুঁসে উঠেছে এখানকার লাখো মানুষ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যের বহু কিছু সিআরবির সাথে জড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষায় চট্টগ্রামের মানুষ দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছে। তারা নিজেদের কষ্টের কথা, আবেগের কথা ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে তুলে ধরেছে। সরকার দলীয় মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে বহু নেতাকর্মীই প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে এখানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। তাদের কেউই চট্টগ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিরোধী নন। স্বাস্থ্যখাতের যেই বেহাল দশার বর্ণনা শুরুতে দিয়েছি তাতে এখানকার মানুষ মনে করে, এখানে আরো অনেকগুলো হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু সিআরবির ব্যাপারেই মানুষের আপত্তি। শহরের আরো বহু এলাকায় বড় পরিসরে হাসপাতাল কিংবা মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। পাহাড়তলী থেকে শুরু করে শহরের ভিতরেই রেলের বহু জায়গা রয়েছে। যেখানে অনায়াসে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলা যায়। ইউনাইটেডের মতো প্রতিষ্ঠান বৃহৎ বিনিয়োগে চট্টগ্রামে আসলে সবাই স্বাগত জানাবে। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বলা হচ্ছে রেলওয়ের বিদ্যমান ছোট্ট হাসপাতালটিকে কেন্দ্র করে পেছনের ছয় একর জায়গায় প্রস্তাবিত হাসপাতালের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। যাতে শিরীষ তলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আপনাকেও নিশ্চয় ওভাবেই বুঝানো হয়েছে। কিন্তু ৫০০ বেডের হাসপাতাল, ১০০ ছাত্রছাত্রীর মেডিকেল কলেজ, ৫০ জন নার্সের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পর এলাকাটিতে যে পরিমাণ লোক এবং গাড়ি সমাগম হবে তাতে সিআরবিতে আর দম ফেলার সুযোগ থাকবে না, থাকা স্বাভাবিক না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি অনুগ্রহ করুন। চট্টগ্রামের মানুষের দম ফেলার এবং বুক ভরে শ্বাস নেয়ার জায়গাটি রক্ষা করুন।