দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ছোট-বড় প্রায় আড়াই শতাধিক পাটকল রয়েছে। পাটকলগুলোতে পাটজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচা পাটকে মসৃণ করার জন্য জুট বেসিন অয়েল (জেবিও) ব্যবহার করা হয়। পাটজাত পণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় জেবিওর ব্যবহার কমে আসছিল। তবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বেসরকারি পাটকলগুলোতে পাটের যোগান কম থাকার পরেও আনুপাতিক হারে জেবিওর চাহিদা তেমন কমেনি।
অভিযোগ উঠেছে, সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম মূল্যের জেবিও সয়াবিনের সাথে মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে দেশীয় পাটকলগুলোতে জেবিও ব্যবহারের তথ্য চেয়ে তিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের সাথে জেবিও শরীরে গেলে ক্যান্সারের মতো ঘাতক ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে মানবদেহে। মানবস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয়কর অনেক রোগবালাই দেখা দিতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আলী আজাদীকে বলেন, জেবিও এক ধরনের পেট্রোকেমিক্যাল পদার্থ। পাটজাত দ্রব্য তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এখন এসব কেমিক্যাল ভোজ্যতেলের সাথে মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হলে এবং এসব তেল খাবারের সাথে মানুষের শরীরে গেলে পরিপাকতন্ত্রে প্রদাহ হতে পারে, বদহজম হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে পরিপাকতন্ত্রে জটিলতা, কিডনির জটিলতা হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে। এছাড়া শরীরে চর্মরোগও তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রীয় ২৫টি জুটমিল বন্ধ করে দেয় সরকার। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ৯টি। সরকারি এসব পাটকল ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে দুই শতাধিক পাটকল রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজেএমসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ওই ২৫টি মিলে ২ লক্ষ ১০ হাজার মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য তৈরি হতো। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮০ হাজার মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য উৎপন্ন হয়েছে। এই ১০ বছরে ধীরে ধীরে জেবিওর চাহিদা মিলগুলোতে কমে গেছে।
তিনি জানান, সরকারি মিলগুলো থেকে মোট উৎপাদনের ৩০-৪০ শতাংশ পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হতো। অবশিষ্টগুলো বেসরকারি পাটকলগুলোতে উৎপাদিত হতো। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি উন্মুক্ত করে দেয় সরকার। এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে বিরাট অংশের কাঁচা পাট কিনে নেয় ভারত। এতে দেশীয় বাজারে কাঁচা পাটের দাম বেড়ে যায়। এছাড়া মহামারির কারণে পাটের উৎপাদন কমে যায়। যে কারণে বিগত অর্থবছরে বেসরকারি জুটমিলগুলোতে তেমন পাটজাত পণ্য তৈরি হয়নি। এতে জেবিওর চাহিদা একেবারে কমে যাওয়ার কথা। বিগত অর্থবছরে জেবিওর বেশি চাহিদা থাকলে কিংবা বিপিসি থেকে সরবরাহ দেওয়া হলে তা রহস্যজনক দাবি করে তদন্ত করে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বন্ধ হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের এম এম জুটমিলের ব্যবস্থাপক মো. সেলিম আজাদীকে বলেন, জুটের ফাইবারগুলো শক্ত ও ভঙ্গুর। জুট কাঁচামালকে প্রথমে মসৃণ করার জন্য তেল (জেবিও), সাবান ও পানি দিয়ে ইমালশন তৈরি করা হয়। মেশিনের পিঠগুলোতে জুট দেওয়ার আগে মসৃণ হওয়ার জন্য এসব ইমালশন ব্যবহার করা হয়। ওজন অনুপাতে আড়াই থেকে ৬ শতাংশ জুট বেসিন ওয়েল ব্যবহৃত হয়।
সূত্রে জানা যায়, সয়াবিন তেলের চেয়ে জেবিওর দাম কম। দেখতে সয়াবিন তেলের মতো। অভিযোগ উঠেছে, রাষ্ট্রায়াত্ত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কিছু পাটকল মালিক জেবিও কিনে সয়াবিন মিলের মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী এগুলো সয়াবিন তেলের সাথে মিশিয়ে খোলা বাজারে ছাড়ছেন। এর আগে ২০১৪ সালে সয়াবিন তেলে জেবিও মেশানো রোধ করার জন্য বিপিসির পক্ষ থেকে জেবিওর দাম বাড়ানো হয়েছিল।
বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বণ্টন ও বিপণন) মো. মোরশেদ হোসাইন আজাদ আজাদীকে বলেন, জুট বেসিন অয়েল জুটমিল ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহারের সুযোগ নেই। বিপিসির বিপণন কোম্পানিগুলো জুট মিলগুলোতে জেবিও সরবরাহ করে। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে শুনে আসছি, সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম দামের জুট বেসিন অয়েল সয়াবিনের সাথে মিশিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। খবরটি সত্য হলে এটি খুবই ভয়ঙ্কর। তাই জুট মিলগুলোতে জেবিও সংগ্রহের পর সঠিকভাবে ব্যবহার করছে কিনা, জুট মিলগুলোতে জেবিওর ব্যবহারভিত্তিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বিপিসি থেকে তিন বিপণন কোম্পানিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে জেবিও মিশ্রণের সত্যতা পাওয়ার পর বিপিসির পক্ষ থেকে জেবিওর দাম বাড়ানো হয়েছিল। দাম বেড়ে গেলে অবৈধ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর এ ধরনের প্রবণতা থাকবে না।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, একমাত্র ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ডিজেল পেট্রোলের উপজাত হিসেবে জেবিও উৎপাদন হয়। সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলোতে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৮৫৯ মেট্রিক টন, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১৭ হাজার ১৩৩ মেট্রিক টন, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৯১০ মেট্রিক টন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১২ হাজার ৯৮৪ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১২ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৭৭ মেট্রিক টন জেবিও সরবরাহ দেয় বিপিসির তিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানি।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ৫ নভেম্বরের বিপিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিপণন কোম্পানিগুলো চট্টগ্রামে প্রতি লিটার জেবিও ৮৯ টাকা ৪ পয়সা, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা এবং খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে ৯০ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে খোলা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিনের মূল্য ১৩০-১৩৫ টাকা। বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ১৪৫-১৫০ টাকা।
হিসেব মতে, সয়াবিন তেলের সাথে ৫০ঃ৫০ অনুপাতে জেবিও মেশানো হলে প্রতি লিটারে কমপক্ষে ২০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করা যায়। এতে ৯ হাজার লিটারের এক ট্যাংক লরি সয়াবিনের সঙ্গে সমপরিমাণ জেবিও মেশালে বর্তমান বাজারদরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি অবৈধভাবে মুনাফা করা সম্ভব।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক (মেট) শওকত ওসমান আজাদীকে বলেন, জুট বেসিন অয়েল হচ্ছে পেট্রোলিয়াম উপজাত। সয়াবিনের সাথে মেশানো হলে মানব শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তবে এ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখব।