মুক্তি সংগ্রামের রক্তঝরা ইতিহাস ও এক বীর মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়স্পর্শী কথা

প্রফেসর ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৩ জুলাই, ২০২১ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ইতিহাস মুক্তি সংগ্রামের রক্তঝরা ইতিহাস। দ্বি-জাতিতত্তের ভিত্তিতে ভূখণ্ডের বিভক্তি, মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়া, সামরিক শাসন-শোষণের যাঁতাকল, বঞ্চনা-প্রবঞ্চনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি হচ্ছেন প্রবীণ লেখক এবং অব: বিভাগীয় প্রকৌশলী, বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া। তিনি ইতোমধ্যে সাতটি বহুমাত্রিক পুস্তক প্রণয়ন করেন। তাঁর তথ্যবহুল ইতিহাস দালিলিক গ্রন্থসমূহের আয়তন ও উচচতা সংখ্যাবাচক নয় কিন্তু গুণগত উপাদান-আকারে এক অনন্য অনুভূতি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎসের পুস্তকটি প্রামাণ্য হালচিত্রের যেন জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। প্রথমত মুক্তিযুদ্ধে আমি অধ্যায়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠ্যকালীন ধর্মীয় শিক্ষক কর্তৃক উর্দু বর্ণমালার বই ধরিয়ে দেয়া, পোস্টকার্ড এবং দোকানের সাইনবোর্ড উর্দুতে লিখন প্রভৃতি লেখকের কোমল হৃদয়ে ঔপনিবেশিক গ্লানির গভীর প্রতিক্রিয়া ও রেখাপাত তৈরি করে। একই সঙ্গে বাঙালি জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। তমুদ্দিন মজলিশ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পটভূমি তাঁর স্মৃতিপটে ও লেখনীতে উল্লেখযোগ্য। দু’হপ্তার মধ্যে তিনজন নামজাদা প্রাবন্ধিক মাতৃভাষার স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে মধ্যবিত্ত সমাজ ও ছাত্রসমাজে ভাষা ও অধিকার বিষয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শ’খানেক বুদ্ধিজীবীদের আন্তরিক সহযোগিতায় ১৪ নভেম্বর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন-এর নিকট স্মারকলিপি প্রদানের পদক্ষেপ ৩০ ডিসেম্বর ৪৭ খ্রিস্টাব্দ সর্বপ্রথম ডা. নুরুল হক ভূঁইয়ার আহবানে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। অধিকন্তু মুক্তিযোদ্ধা জয়কেতু বড়ুয়া পরে উদ্ধৃতি দেন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ মন্ত্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্তৃক গণ-পরিষদে বিল উত্থাপন ও নাকচ হওয়া একটি ভাষা আন্দোলনে নির্ণায়ক সূচনা। যাতে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট আহুত হয়, যা ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ মার্চ পর্যন্ত চলমান ছিল। দেশের অচলায়তনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মন্ত্রী ফজলুল হক, অধ্যাপক আবুল কাশেম এবং খাজা আহমেদ গ্রেফতার হন। মুক্তিযোদ্ধা লেখক যথার্থই বলেছেন, ১৯ শতকে, ৪৯, ৫০, ৫১ সাল পর্যন্ত দেশের জনগণ (মুসলিম লীগের গুটি কয়েক সদস্য ছাড়া) বাংলা ভাষার আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন ও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। উক্ত কালজয়ী বীরত্বের গাঁথা এখানে সংযুক্ত করে সুলেখক স্বচ্ছ ইতিহাসের খসড়া প্রণয়ন করেন। সরকারহাট নজরালী রূপজান হাইস্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় তরুণ লেখক ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ স্লোগান নিয়ে সতীর্থদের সাথে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন অবরোধ এমনকি নিজামপুর হাইস্কুলে সমাবেশ সত্যি সত্যি তাঁর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, প্রতিবাদ ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্পৃক্ততা নিবিষ্টভাবে প্রমাণিত। সেদিন তাঁর সহযোগী ছিলেন আজাদীর সাংবাদিক কাজী জাফর ও রবিউল হোসেন, এডভোকেট সনজীব বড়ুয়া, হেডমাস্টার রবিউল হোসেন ও মফিজউদ্দীন ও ড. শহীদুল্লাহ অন্যতম। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎস, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে (১৯৭১-২০২১) এবং মুজিব শতবর্ষে গ্রন্থনাটি একটি সম্পূরক সংযোজনা।
দ্বিতীয়ত: লেখকের শৈশবে ১১ মার্চ, ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ও ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনকে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম আন্দোলনের প্রাক্কালে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি তাঁকে মনন ও চেতনায় তাড়া করে সমগ্র জীবন। ভাষা সৈনিকের প্রতি গুলি বর্ষণে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিকুর ও শফিউল্লাহ প্রমুখ অনেকেই। তরুণ বাঙালি ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে যথার্থ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। মোট ৩৫ জন সাংসদের পদত্যাগ পরিস্থিতি নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। ভাষা আন্দোলনে তিনি নারী শিক্ষাবিদদের কথা স্বীকৃতি দিয়ে নারীসমাজ, মাতৃজাতি এবং মাতৃভাষার প্রতি অধিকতর সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সর্বজন নন্দিত লায়লা নূর, ড. সুফিয়া খাতুন, ড. শরীফা খাতুন, অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও ডক্টর হালিমা খাতুন আরো অনেকেই।
‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’ গ্রন্থটির উদ্দেশ্য, উপকরণ, উৎস এবং আবশ্যিক অনুষঙ্গ বিষয়সমূহ সমকালীন ও যথার্থ। ভাষা আন্দোলন হতে স্বাধীনতা দিবসের হৃদয়স্পর্শকারী বিভিন্ন স্লোগান, ৬ দফা, ৭ই মার্চের ভাষণের তৎক্ষণাৎ তাৎপর্য ও প্রতিফলন, ৭ই মার্চের ভাষণোত্তর শেখ মুজিবের দাবীসমূহ, বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রাক্কালে স্বাধীনতা ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র, প্রবাসী সরকারে সহকর্মীদের তালিকা, স্বাধীনতা যুদ্ধে ২৫ মার্চ নিহত বুদ্ধিজীবীদের নাম ও ১৪ ডিসেম্বর (শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস) রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নিহতদের নাম এবং ঐতিহাসিক দলিলের ন্যায় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার দিনপঞ্জি সংযুক্ত করায় পুস্তকটির একাডেমিক মান ও গবেষণামূল্য উচ্চতর মর্যাদায় সমুন্নত।
তৃতীয়ত: মাওলানা ভাসানীর গণমুখী বচন, ইংরেজরা ২০০ বছরের শাসনে যত লুটপাট করেনি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ২৪ বছরে তার বহুগুণ বেশি লুটপাট করেছে। ভাবনাটি সহজ-সাধারণ জনমনে কৌতূহল ও আগ্রহের দানা বেঁেধ চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ৩০৯ টি আসনে ২৯১টি আসন লাভ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, ৬২ সনে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সনে ৬ দফা আন্দোলন এবং ৮ই মে’র নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিক আন্দেলনে মনুুমিয়াসহ ১১ জন নিহত হওয়ায় উদ্ধৃতিসমূহ লেখক স্বল্পপরিসরে সন্নিবেশিত করে মুক্তি সংগ্রামের স্বপক্ষে সহজাত ঔদার্যবোধ প্রদর্শন করেছেন।
চতুর্থ অধ্যায়ে: পাকিস্তানের ২৩ বছরে বঙ্গবন্ধুর ১৩ বছর কারাবরণ ও ১২ বছর পুলিশি নজরদারী বিশ্ব ইতিহাসে একটা ব্যতিক্রমধর্মী আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত। জাতির প্রত্যাশা ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, কারাগারে প্রেরণ, ১৭ জানুয়ারি মুক্তি, জেল ফটকে পুনঃআটক ও সেনানিবাসে আটক, ১৯৬৯ এ ৬ দফা ও ১১ দফার গণ আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও আগরতলা ষড়যন্ত্র সকল আসামীর মুক্তিলাভ মুক্তিযুদ্ধের গতি ও ক্রিয়া কর্মসূচিকে অধিকতর ত্বরান্বিত করে।
পঞ্চম অধ্যায়ে: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যাতে বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামী করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা এবং রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে সংবর্ধনা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান; ঊনসত্তুরের অসহযোগ আন্দোলন ও সত্তুরের নির্বাচন। ঐতিহাসিক ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে অংশ ১৬৯ আসনে ১৬৭টি আসন লাভ একটি ব্যালট বিপ্লব, যাতে মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের জন্য ও স্বাধিকার লড়াইয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে: প্রাজ্ঞ লেখক ৭ মার্চের ভাষণ ও তার ফলিত বিষয়ে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও স্বাধীনতার ডাকে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিচ্ছবি সংযুক্ত করেছেন: ১ ও ২ সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রিম কোর্ট চলবে না, চলে নাই; ৩ ও ৪, গরীবেরা যাতে কষ্ট না পায়, রিকশা গরু-গাড়ি ও রেল লঞ্চ চলবে- চলেছিল; অনুরূপ ৫ তারিখ বেতন ভাতা প্রাপ্তি-পেয়েছিল, প্রভৃতি যুগান্তকারী গণবান্ধব সিদ্ধান্ত বিশ্ব ইতিহাসে বিরল বলে লেখক অভিমত প্রকাশ করেন। সচেতন ও প্রবীণ লেখক অকপটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন তিনি ডায়েরীভিত্তিক ভালোলাগার টুকিটাকি এবং মহিউদ্দীন আহমেদ-এর ‘যুদ্ধ দিনের কথা ১৯৭১’, মেজর রফিকুল ইসলাম-এর ‘মুক্তিযুদ্ধের দু’শ রণাঙ্গন’, শফিউদ্দিন তালুকদারের ‘একাত্তরের গণহত্যা’ এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান-এর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ সহায়ক গ্রন্থাবলী উল্লেখযোগ্য।
সপ্তম অনুচ্ছেদে, ৭ মার্চ, শ্রীমঙ্গল তাঁর কর্মস্থল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সাথে জড়িয়ে পড়েন। কুলাউড়া, শায়েস্তাগঞ্জ, নোয়াপাড়া ও হবিগঞ্জ থেকে খোয়াই বর্ডার পর্যন্ত ভৌগোলিক ব্যাপ্তি ছিল তাঁর চাকরির কর্মপরিধি। একাত্তুরের ২১-২৫ মার্চ স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা লাভ, পানি ও বিদ্যুৎবিহীন পাক সেনাবাহিনীর অভিযান ভীতি, কৃতজ্ঞতায় চিকিৎসকদের নামোল্লেখ, বন্ধু, আশ্রয়দাতাদের পরিচিতি, বাচ্চাদের মানবিক আশ্রয় ও জনৈক এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের মানবিক সহায়তা প্রভৃতি জ্বলন্ত দুঃসময়ের সরস বর্ণনায় এক নির্মম গণহত্যার চিত্র প্রতিভাত হয়। তাঁর লেখনীতে শহীদ সার্জন শামসুদ্দিন ও ডা. শ্যামল দত্তসহ বেশ ক’জন চিকিৎসকদের পাশবিক হত্যার করুণ তথ্য সম্বলিত প্রভৃতি প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের হালচিত্র, ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চায় প্রশংসিত অধ্যায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর। আগুনঝরা ২৫ মার্চের কালোরাত্রি স্বাধীনতার ডাক ও দলিল: ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন, মুক্তি সংগ্রামের রক্তঝরা দিনগুলো তাঁর বিন্যস্ত উপকরণ গ্রন্থকে সমৃদ্ধ করেছে।
অষ্টমত: অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের দায়িত্বশীল কার্যকাল: প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিবের দপ্তরে কর্তব্যরত সতীর্থদের তালিকা ও বিশ্ব জনমত।
নবমত: স্লোগান ও বিশ্লেষণ। দশম অধ্যায়: বিজয় দিবস, ২ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বর ধরে নিয়ে শহিদের তালিকা, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অপর এক মুক্তিযোদ্ধার সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা (অবঃ) ডিআইজি এস. কে. চৌধুরীর ভগ্নিপতি। বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন (অবঃ) বিভাগীয় প্রকৌশলী যিনি জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আজাদী, জনকন্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকার নিয়মিত লেখক। গ্রন্থকার প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া প্রায় তিন দশক ধরে মন, মানুষ, মাটি ও স্বদেশের কথা নিঃসঙ্কোচে লিখেছেন নিরন্তর। উপলক্ষ, মানবতা, মনুষ্যত্ব, মনন ও মেধায় অন্ধকার বিনাশী আলোর উজ্জ্বলতায় এক আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক যুব মানস প্রতিষ্ঠা করা। জীবন-জীবিকা, মানব-প্রকৃতি, প্রেম ও পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্যের বাণী সতত প্রচারে স্বীয় সধর্মের কিছু যুক্তিযুক্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সুপ্রাচীন তথ্য ও সংশ্লিষ্ট কাহিনি তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। তাঁর সৃজনশীল গ্রন্থনাসমূহ হচ্ছে বাচ্চু স্মৃতি তর্পণ, বুদ্ধ-বুদ্ধগয়া ও ধর্মকথা (১৯৯৮), পৃথিবী ও প্রেম (২০০৫), জীবন নিয়ে খেলা (২০০৫), সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ শোকাঞ্জলি (২০০৮), জাতকের গল্প (২০১১) এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’ (২০২১)। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী সদা হাস্যময়ী প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়ার ভূমিকা, সূচনা, ধারাবাহিক বর্ণনা ও ভাবভাষা সহজবোধ্য, সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ও বর্ণনায় আড়ম্বর বিবর্জিত। স্বদেশপ্রেম, সংগত অনুপুঙ্খ তথ্য ও শোভনীয় উপস্থাপনায় এই পুস্তকটি সর্বমহলে পাঠক বিদিত এবং নন্দিত হবে-এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস-প্রত্যাশা।
উপসংহারে বলতে চাই, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’ একটি অভূতপূর্ব উপহার। গ্রন্থটির তিনটি মূল নির্যাস, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু এবং একজন প্রতিশ্রুতিশীল মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ কলমের আঁচড়ে। সর্বপ্রথমে: ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, কথা সাহিত্যিক আবুল ফজল যথার্থ বলেছেন। লেখকের শৈশব, ছাত্র ও কর্মজীবন, মুক্তি সংগ্রামের রক্তঝরা দিনগুলো, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের মুহূর্তগুলো এবং তাঁর সুস্পষ্ট স্বচ্ছ অভিমত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার’ কথাটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৫ মার্চ মুক্তি পান। দেশব্যাপী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ২রা জানুয়ারি মুক্তি পান। পুনঃ জনমত সৃষ্টির মানসে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী আন্দোলনে ১৯৪৯ সালে ১লা এপ্রিল গ্রেফতার ও জুলাই মাসে তিনি মুক্তি পান। একই বছরে ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে জনসভা শেষে ভুখা মিছিলে মধ্যমণি শেখ মুজিবুর রহমান, সভাপতি মাওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গ্রেফতার হন। প্রায় দু’বছর পাঁচমাস জেল খাটার পর ১৯৫২ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্সে স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসমাবেশে তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। একাত্তরের ৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায় তাঁকে জাতির পিতা নামে অভিহিত করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে আমি বলবো, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’।
নিবেদিত মানবতাবাদী এবং প্রধান প্রকৌশলী রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের প্রশংসিত মুক্তিযোদ্ধা তাঁর জীবনের প্রিয় দেহ ও চক্ষুদ্বয় মরণোত্তর আইনগত উৎসর্গ ও দান করেছেন। ইতোপূর্বে তাঁরই স্বর্গীয় স্ত্রী অর্পিতা বড়ুয়া টুলু ২০০৮ সনে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দান করে দু’জন অন্ধকে আলো ও জ্ঞান দান করে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমাদের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ লেখক প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া গ্রন্থটির নামকরণ সার্থকতা, ভাব ভাষা ও বর্ণনার রসায়নে উপরোক্ত ঐতিহাসিক বাণীর স্পষ্ট ইঙ্গিত ও মর্মের প্রতিফলন ঘটেছে। পুস্তকটি পাঠান্তে লেখকের প্রশংসা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিপাগল পাঠক নিঃসংশয়ে উচ্চারণ করবেন সহজ সরল মনে, এটাই আমাদের বিশ্বাস। লেখকের নির্মল চিত্তের স্বদেশ প্রেম-মায়ের ভাষা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মাননা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের স্মারক বিধিত অভূতপূর্ব একটি গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
চট্টগ্রাম (ইউ এস টি সি)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্য সমস্ত বাধা অপসারণ করা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দোয়া মাহফিল