সীতাকুণ্ডে এলপিজি সিলিন্ডার স্ক্র্যাপিংয়ের বড় সিন্ডিকেট

অভিযানে জব্দ ১৩শ স্ক্র্যাপ সিলিন্ডার

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৩ জুলাই, ২০২১ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এলপিজির ভর্তুকির সিলিন্ডার সংগ্রহ করে স্ক্র্যাপিংয়ের একটি বড় সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। বিভিন্ন এলপিজি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গতকাল সোমবার দুপুরে সীতাকুণ্ড থানার একটি স্পেশাল ফোর্স বানুর বাজারে অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেটটির সন্ধান পায়। অভিযানকালে প্রায় ১৩শ স্ক্র্যাপ সিলিন্ডার জব্দ করে পুলিশ। এলজিপি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, এলপিজি বাজার সম্প্রসারণের জন্য কোম্পানিগুলো ভর্তুকিমূল্যে সিলিন্ডার বাজারে ছাড়ে। এখন কমমূল্যের খালি সিলিন্ডার কিনে স্ক্র্যাপ করে ফেলা হচ্ছে। এতে কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলপিজি সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে পড়ছে।
এ বিষয়ে গতকাল সোমবার রাতে সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কুসুমের ইয়ার্ডে অভিযান চালিয়ে অনেক সিলিন্ডার জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।’
এ বিষয়ে লাফস এলপিজির এরিয়া ম্যানেজার একরামুল হক জুয়েল সোমবার দুপুরে পুলিশি অভিযানের সময় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকদিন ইয়ার্ডটিতে নজরদারি করেছি। ইসমাইল হোসেন কুসুম দীর্ঘদিন ধরে এসব সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করছেন। রোববার বিকেলে আমরা ওইখানে গিয়ে সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করার দৃশ্য দেখতে পাই। রাতে আমরা কয়েকজন প্রহরী নিয়ে অবস্থান করলেও তারা রাতের বেলা ট্রাকে করে কাটা অনেক সিলিন্ডার সরিয়ে নিয়েছে। এখন সীতাকুণ্ড থানাকে অবহিত করেছি। তারা অভিযান চালাচ্ছে। এখনও অনেক কাটা সিলিন্ডার গোডাউনের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন নতুন সিলিন্ডারগুলো স্ক্র্যাপ করে ফেলার কারণে কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের বিনিয়োগ মাঠে মারা যাচ্ছে। এখানে ১৫-১৬টি কোম্পানির সিলিন্ডার কাটা হয়েছে। ইতোমধ্যে জব্দকৃত সিলিন্ডারগুলো তদন্তের সুবিধার জন্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে ইউনিভার্সেলের ইয়ার্ডে রাখা হবে।’
জি-গ্যাসের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রাজু আহমেদ রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ কাটা সাড়ে পাঁচশসহ ১৩শ সিলিন্ডার জব্দ করেছে পুলিশ। জব্দকৃত সিলিন্ডারের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাতশ সিলিন্ডারের বাল্ব খুলে ফেলা হয়েছে। এগুলোও পর্যায়ক্রমে স্ক্র্যাপ করা হতো।’
সীতাকুণ্ড থানার এসআই মাহবুব গতকাল রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ডিপোটির জমির মালিক মো. মহসিন নামের এক ব্যক্তি। তিনি জায়গাটি ভাড়া দিয়েছেন। কুসুম নামের যিনি এসব সিলিন্ডার কাটছেন অভিযোগ করা হয়েছে, তাকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। আমরা এখনো (রাত সাড়ে আটটা) ঘটনাস্থলে আছি। সিলিন্ডারগুলোর জব্দ তালিকা তৈরি করছি।’
গতকাল সোমবার দুপুরে পুলিশি অভিযান শুরুর সময়ে সরেজমিনে ওই ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এলপিজিএলের পুরোনো সিলিন্ডারগুলো কাটা হয়নি। শুধুমাত্র প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন নতুন সিলিন্ডার কেটে স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে ডিপোতে। সিলিন্ডারগুলো কাটার জন্য মজুদ করা হয়েছে অঙিজেন গ্যাসও। সিলিন্ডার কেটে পুরো ইয়ার্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। বসুন্ধরা, ওমেরা, লাফস, বিএম, ইউনিভার্সেল, পেট্রোম্যাঙ, ডেল্টা, ইউনি গ্যাস, জি গ্যাস, পদ্মা, লাফস, বিন হাবিবসহ অনেক কোম্পানির কাটা সিলিন্ডার রয়েছে।
এসময় এলপিজি কোম্পানিগুলোর কয়েকজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সব সিলিন্ডার কাটার সাথে জড়িত গোডাউন মালিক ইসমাইল হোসেন কুসুম গা-ঢাকা দিয়েছেন। তার মুঠোফোনও বন্ধ। চট্টগ্রাম মহানগরীর আবু তাহের নামের এক বড় ডিস্ট্রিবিউটর এসব সিলিন্ডার সরবরাহের সাথে জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি।
এদিকে পুলিশের অভিযানের সময় সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে হাজির হন ইয়ার্ডটির ভূমি মালিক মো. মহসিন। তিনি কোন প্রকার ছবি তুলতে নিষেধ করেন। পরে সোমবার রাতে ভূমি মালিক মো. মহসিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘কুসুম একটি গ্যাস কোম্পানির (এলপিজি) মালিক। তাছাড়া তার আরও ৮টি কোম্পানির ডিলারশিপ রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন কোম্পানির ডিলারদের কাছ থেকেও সাব ডিলার হিসেবে মাল (গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার) নেয়। প্রতিমাসে ৫০-৬০ হাজার বোতল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ইয়ার্ডে সরবরাহ দেয়। ওখানে প্রতিমাসে ১-৩ শতাংশ সিলিন্ডার ডেমেজ হয়ে যায়। এগুলো কোম্পানিগুলো ফেরত নেয় না। এসব ডেমেজ সিলিল্ডার কেটে বিক্রি করে দেয়।’ এ বিষয়ে ইসমাইল হোসেন কুসুমের বক্তব্য নিতে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বর্তমানে দেশে গৃহস্থালি, হোটেল, রেস্তোঁরায় একটি জনপ্রিয় জ্বালানি। বর্তমানে ৫৭টি অপারেটর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিলেও ২৭টি অপারেটর বাজারে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বছরে প্রায় ১২ লাখ টনের বেশি এলপিজি আমদানি করে বোতলজাত করে সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করছেন। এখাতে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
এলপিজি বোটলার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লাবাব) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শামীম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার তৈরি করতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। কোম্পানিগুলো একেকটি সিলিন্ডারে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ভর্তূকি দিচ্ছে। গ্যাস রিফিল করার মাধ্যমে এসব ভর্তুকি পুষিয়ে নিতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের অনেক স্থানে নতুন নতুন সিলিন্ডার কেটে স্ক্র্যাপ করে ফেলা হচ্ছে। এটি পুরো এলপিজি সেক্টররের বিনিয়োগকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলছে। এখন সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া এসব অনিয়ম বন্ধ করা কষ্টাসাধ্য হয়ে পড়বে।’
বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ইসমাইল হোসেন কুমুম একজন এলপিজি ডিলার। এসব এলপিজি বিপণনে বাজার সম্প্রসারণের জন্য সিলিন্ডারগুলো ভর্তূকি দিয়ে বিক্রি করে এলপিজি কোম্পানিগুলো। এখন লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব সিলিন্ডার কেটে স্ক্র্যাপ করে রোলিং কারখানায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এসব সিলিন্ডার কিনলেও কাটা সম্পূর্ণ অবৈধ। কুসুমের নামে বিস্ফোরকের যে লাইসেন্স রয়েছে সেটি অন্যস্থানের। যেখানে সিলিন্ডার কাটা হচ্ছে, সেটাতে এলপিজি সিলিন্ডারও উনি মজুদ করেছেন। বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়া এলপিজি মজুদও অবৈধ। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বাজারে প্রতি টন ৬০ গ্রেডের রড কোম্পানিভেদে ৭৬ হাজার থেকে ৭৭ হাজার টাকা, ৪০ গ্রেডের রড ৬৪ থেকে ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিগত এক বছরে প্রতি টন লোহায় ১৫-১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে করে স্ক্র্যাপ লোহার দামও বেড়েছে বাজারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোভিড টিকার জন্য খালেদার নিবন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল লঘুচাপ