জীবনের গল্প-বলতে চাই অল্প
করোনাভাইরাস তাণ্ডবে বাংলাদেশ এখন বিপর্যস্ত। আমাদের মতো বয়সের মানুষ চিন্তা ভাবনার দিক থেকে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। যেভাবে মৃত্যুহার এবং সংক্রমণের পরিমাণ বেড়েছে তাতে গ্রামে এবং শহরে অনেক পরিবার হয়তো তাদের জ্যেষ্ঠ বয়সী বা মাঝারি বয়সের সদস্যকে হারিয়েছে। জানিনা আমাদের মধ্যে কার কি অবস্থা হবে? এরকম দুর্ভাবনার মধ্যে আমার দিন কাটে। চার পাঁচদিন আগে গণমাধ্যমে একটি খবর দেখলাম যা কিছুটা আনন্দের। খবরটি হলো তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামার ৯৬তম জন্মদিনে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নরেন্দ্র মোদী নিজেও একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, ৯৬ বছর বয়সের একজন মানুষকে শুভেচ্ছা জানানোর ব্যাপারটি উভয়ের জন্য আনন্দের বিষয়। চীনের সাথে দালাইলামার সম্পর্ক খুবই খারাপ হওয়ার কারণে ভারত এতোদিন প্রকাশ্যে দালাইলামাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি। এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে তিব্বতের আধ্যাত্মিক গুরুকে শুভেচ্ছা জানালেন। আমি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। এইসব কথা বলার পেছনে আমার উদ্দেশ্য হলো ৯৬ বছর বয়সের একজন মানুষ জীবিত আছেন এবং সক্রিয়ভাবে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন এটা শুনতে আমার ভালো লাগে। ৯৬ বছর বয়সের এই ধর্মগুরু কেমন বোধ করছেন? কিভাবে তার দিন কাটছে?
৯৮ বছর বয়সী মো. ইউসুফ সরওয়ার খান চার পাঁচদিন আগে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে একমাসের অধিককাল শ্বাসকষ্ট এবং বার্ধক্যজনিত রোগ ভোগ করার পর পরলোকগমন করেছেন। তাঁর স্ত্রী ৭৬ বছর বয়সী পর্দা কাঁপানো সাবেক অভিনেত্রী সায়রা বানু বলেছিলেন ইউসুফ খানের অবস্থা কিছুটা ভালো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতবাসীকে কাঁদিয়ে তিনি ওপারে চলে যান। ইউসুফ খানের জন্ম পাকিস্তানের পেশোয়ার এলাকায়। তার অভিনয় জীবন কেটেছে বলিউডে। তিনি হচ্ছেন ভারতের সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা দিলীপ কুমার। ১৯৫৪ সালে প্রথম তিনি জোয়ার ভাটা সিনেমায় অভিনয় করেন। ভারতের শ্রেষ্ঠ মুভি ‘মুঘলে আজম’ এ অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মনে স্থান করে নেন। তার অনেক সিনেমা যেমন-‘আন’ ‘আজাদ’ ৫০ ও ৬০ এর দশকে পূর্বপাকিস্তানে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ভারতীয় অভিনেত্রী নার্গিস কিংবা মধুবালার সাথে তার সম্পর্ক নিয়েও সিনেমা জগতে নানা রটনা ছিল। তার অভিনয়ের এমন ক্যারিশিমা ছিল যে তিনি একটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ১ লক্ষ টাকা করে সম্মানী নিতেন। ৫০ এর দশকে এক লক্ষ টাকা আজকের কত টাকার সমান অনুমান করে দেখতে পারেন। আমি যতটুকু জানি তখন এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৭০ টাকা বা তার কিছু বেশি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দিলীপ কুমার অতি জনপ্রিয় ছিলেন। তার ছবি ‘আজাদ’ চট্টগ্রামের উজালা সিনেমা হলে মাসের পরে মাস দেখানো হয়েছিল। তারপরও দর্শকরা হলের দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করতো। তখন চট্টগ্রামে খুব বেশি সিনেমা হল ছিলো না। ৫টি হলের মধ্যে ছিল উজালা, সিনেমা প্যালেস, খুরশিদ মহল, নিরালা (রঙ্গম) এবং অনিল বাবুর টকিজ (লায়ন সিনেমা)। পরবর্তীকালে আমবাগান থেকে ভেতরের দিকে পাহাড়ি এলাকায় গুলশান সিনেমা, স্টেডিয়ামের উত্তরে বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহ আলমাস সিনেমা এবং নিউমার্কেটের সামনে জলসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা আমদানী বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিলীপ কুমারের সিনেমায় হল মালিকেরা বঙ অফিসে এতো মুনাফা করেছিলো যে তারা প্রত্যেক টিকেট ক্রয়কারীকে একটি করে রুমাল উপহার দিতে শুরু করেছিল। এই কিংবদন্তী নায়ক ৯৮ বছর বেঁেচছিলেন। কেমন কেটেছিল তার জীবনের শেষ দিকের দিনগুলি?
২০১৩ সালে আমি হায়দ্রাবাদ যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে ইস্টপোস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছিলাম। সারাদিন সারারাত ট্রেনে কাটানোর পর পরদিন বিকালে ট্রেন সেকান্দারাবাদ স্টেশনে যাত্রা শেষ করে। ট্রেনটি হায়দ্রাবাদ পর্যন্ত যাবেনা। হায়দ্রাবাদ এবং সেকান্দারাবাদকে টোয়াইন সিটি বলা হয়। দুই শহরের মধ্যে অনেক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের মাধ্যমে শহর দুটি সংযুক্ত। পর্যটকদের কাছে সেকান্দারাবাদ খুবই পছন্দের। স্টেশনের কাছে একটি লজে আমি উঠি। লজের পরিবেশ খুবই সুন্দর। একদিন আমার পরিবারের সদস্যরা শহরে ঘুরতে গেলে আমি লজের লবিতে বসে পত্রিকা পড়ে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিই। সেখানে কোন বাঙালির দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ভাষাগত সমস্যা টুকটাক থাকে। ম্যানেজার আমাকে হায়দ্রাবাদের নামীদামী কয়েকটি ইংলিশ পত্রিকা পড়তে দেয়। সেখানে আমার সাথে হঠাৎ করে এক বাঙালি যুবকের সাথে পরিচয় হয়। সে বোম্বে থেকে এসেছে। কলকাতা এবং বোম্বেতে সে কাপড়ের ব্যবসা করে। আলাপ জমে উঠার পর সে আমাকে জানায় তাদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের চাঁদপুরে। এখন তারা বোম্বেতে সেটেল। বোম্বের সিনেমা পাড়ায় সে কিছু ব্যবসা বাণিজ্য করে বলে আমাকে জানানোর সাথে সাথে আমি তার ব্যবসার আদ্যোপান্ত জানতে না চেয়ে তাকে অন্য একটা প্রশ্ন করি। আমি তাকে বলি সিনেমা পাড়ায় তুমি কখনো দিলীপ কুমারকে দেখেছো? সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বলে আমি সেখানে ব্যবসার কারণে ঘনঘন যাই। সুতরাং স্টারদের সাথে আমার পরিচিত হওয়ার সুযোগ আছে। আমি তাদের দুইজন সুপারস্টার দিলীপ কুমার এবং অমিতাভের ব্যাপারে এখনো এতো বেশি আগ্রহী দেখে সে বিস্মিত হয়। তার কাছ থেকে আমি জানার চেষ্টা করি এই বয়োবৃদ্ধ অভিনেতা কিভাবে জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাচ্ছেন?
করোনাভাইরাসের ব্যাপক তান্ডবের মধ্যে আমাদের সিনিয়র সিটিজনদেরকে নিয়ে আমরা ভাবছি কিনা এটা ভেবে দেখার দরকার আছে। একজন ৭০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কারণ এতো বেশি বয়সের মানুষের নানারকম রোগ থাকতে পারে। তাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়। এইসব মানুষকে ভাইরাস দ্রুত কাবু করে ফেলে। করোনাভাইরাস ছাড়াও কেমন সময় কাটাচ্ছেন অতি বয়স্ক লোকেরা? তাদের প্রতি সরকারের কি কোন মনোযোগ আছে? তাদের জন্য সরকারের কি কোন পরিকল্পনা আছে? সমাজের বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালী লোকজন যারা আছেন তারা সিনিয়র সিটিজনদেরকে নিয়ে কি চিন্তাভাবনা করেন? যারা সমাজ সেবামূলক কাজ করেন, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন তারা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের নিয়ে কি ভাবছেন? কয়েকবছর আগে একজন বড়ো কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন তার কাছে শহরে কিছু জমি আছে, তার পেনশনসহ যা টাকা পয়সা সঞ্চয় করেছেন তা দিয়ে তিনি একটি বৃদ্ধনিবাস করতে চান। আমাকে তিনি আরো বলেছিলেন আমাদের দেশে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ আছে যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। তারা সারাজীবন জাতির জন্য, দেশের জন্য কাজ করেছেন। তাদের অনেকেরই সৌভাগ্য হয়েছে, স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার, বৃদ্ধ বয়সে এসে তারা সবাই কি ভালো আছেন? দালাইলামা যেভাবে জীবন কাটাচ্ছেন কিংবা দিলীপ কুমার যেভাবে জীবন কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন সব ৯০ উর্দ্ধ বয়সের লোক আমাদের দেশে সেভাবে কি জীবন কাটায়? তারা তো আমাদের জন্য অনেক কাজ করে এখন বয়সের ভারে বেকার হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বয়স্ক লোকদের অতি সম্মানের সাথে দেখা হয়। তারা ট্রেনে, বাসে, প্লেনে জার্নি করার সময় সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে সম্মান পায়। তাদের সবদিক থেকে নজরে রাখা হয়। আমাদের দেশে কি সেই ব্যবস্থা আছে? সে ভদ্রলোকের কাছে আমি প্রবীণদের ব্যাপারে অনেককিছু জেনেছিলাম। কানাডায় বসবাসকারী একজন বাঙালি রিসার্চার, যিনি জেনেটিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি আমাকে বলেছেন কানাডায় অতি মানবিক দিক থেকে সিনিয়র সিটিজনদেরকে দেখা হয়। তারা যেখানেই যান তাদের সম্মান দেখানো হয়। ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি মা বাবাকে ছেড়ে চলে গেলেও রাষ্ট্র এবং সমাজসেবী সংস্থাগুলো তাদের আদর যত্নের সাথে রাখে। তাদের শুধু খাবার, কাপড় চোপড় দেওয়া হয় তা নয়, তাদের মানসিক শান্তির জন্য, তাদের চিকিৎসার জন্য, তাদের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য সবকিছু করা হয়। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো ততবেশি উন্নত হয়নাই। টাকাপয়সা থাকলেও অনেক সন্তান মা-বাবাকে পরিত্যাগ করে। কোন কোন সন্তান বাবা-মাকে সাথে রাখলেও তাদের পাত্তা দেয়না। গ্রামীণ জনপদে নিদারুণ অর্থনৈতিক টানাটানির কারণে বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেরা আহার বাসস্থানের কষ্টে পড়ে যান। অনেককে দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। এখন করোনার অভিশাপের ভয়াবহ থাবা সর্বপ্রথম বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে প্রবীণ নাগরিকদের জীবন। আমাদের ভাবতে হবে আজকের এই পৃথিবী, আজকের এই সমৃদ্ধি, আজকের এই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একদিন এই লোকগুলো অনেক কষ্ট করেছেন।
বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত গায়ক এন্ড্রু কিশোর তার বিখ্যাত গানের কলিতে বলেছেন, ‘জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প-’, ৯ মাস ক্যান্সার রোগে ভোগার পর গতবছর তিনি মারা গেছেন। তার মতো সিনিয়র সিটিজেনদের জীবনের গল্প খুব বেশি বাকী থাকে না। যে অল্প সময়টুকু তারা এই দুনিয়াতে থাকবেন, এই সময়টা যেন তারা আনন্দে কাটিয়ে যেতে পারেন। গায়কের আরেকটা গান আছে, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশিদিন তোদের মাজারে-আমি কতজনে, কত কি দিলাম, যাইবার কালে একজনারো দেখা না পাইলাম-।’ আমাদের প্রবীণ নাগরিকদেরকে মৃত্যুর আগে যেন এইরকম আফসোস করতে না হয়। তারা যেন দুঃখ কষ্টহীন মন নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে পারে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।