চেতনার দীপশিখা

শ্যামল চৌধুরী | রবিবার , ১১ জুলাই, ২০২১ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ


‘রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- মানুষের প্রতি বিশ্বাসই সবচেয়ে বড়। এর অমর্যাদা করতে নেই’ অনেক কথার মাঝে এ কথাটি শোনা অরুণ দাশগুপ্তের কাছে। জীবনের প্রাপ্তির খাতায় অর্জন বলতে তিনি মানুষের ভালোবাসাকেই মূখ্য মনে করেছেন। গত ৬ জুলাই বিকেলে বিপ্লবতীর্থ পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে প্রথম যাওয়া আমার। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দাদামণি খ্যাত প্রিয় মানুষ অরুণ দাশগুপ্তকে দেখতে যাওয়া। আমাদের বাড়ি পটিয়ার বেলখাইন থেকে তাঁর বাড়ির দুরত্ব আনুমানিক ২০ কিলোমিটার। অনেকদিনের ইচ্ছে থেকেই অবশেষে তাঁর শেষসান্নিধ্য পেয়েছি। ছায়া সুনিবিড় গ্রামের কাঁচাপাকা পথ পেরিয়ে পৌঁছি বাড়ির উঠোনে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা, পাখির কল-কাকলি কানে বাজে। বাড়ির বারান্দায় দেখলাম ইজি চেয়ার, বুঝতে বাকী রইলো না এটাই অরুণ দাশগুপ্তের বাড়ি। কোন সারা-শব্দ না পেয়ে বাড়িতে কেউ কি আছেন বলতেই পাশের বাড়ি থেকে ষাটোর্ধ মহিলা বের হয়ে আসলেন। বুঝলাম তিনিই প্রতিবেশি নারায়ন বাবুর স্ত্রী যিনি অরুণ দাশগুপ্তর দেখভাল করেন। তিনি অরুণ বাবুর রুমে নিয়ে গেলেন। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের আলোয় খানিক অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে শুয়ে আছেন তিনি। বার্ধক্য যে কতো কঠিন তা দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। টেবিলে কয়েকটি বই ও খাটের শিয়রে কয়েকটি দৈনিক আজাদী পত্রিকা। বালিশ থেকে মাথা উঠাতে পারছিলেন না। ফিরে তাকাতেই আমার সম্পাদিত পত্রিকা ‘অমিতাভ’ এর দুটো সংখ্যা তাঁর হাতে দিই। অমিতাভ পত্রিকায় তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ঋণী ও কৃতার্থ অরুণ দাশগুপ্তের কাছে কারণ তিনি বহুবার আমার আমন্ত্রণে অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেছেন।
এককালের জমিদার বংশের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত। বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। ওইদিন শুয়ে থেকেই আমার সাথে অনেক কথা বললেন। তবে স্মৃতিশক্তি মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেন। মাঝে মাঝে অনর্গল বলতে থাকেন। তাঁকে বললাম- আপনার কাছ থেকে আমরা যা পেয়েছি তা কোনদিন শোধ করার নয়। আজ আপনাকে দেখতে এসেছি। অশীতিপর বয়সেও কণ্ঠের মধ্যে সেই মধুর সুরে কথা বলার ধরণ পাল্টায়নি। এক পর্যায়ে তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার নাম অরুণ দাশগুপ্ত, পিতার নাম অবিনাশ দাশগুপ্ত, মাতা ছিলেন হেমেদপ্রভা দাশগুপ্ত এবং পিতামহের নাম কৃষ্ণকুমার।’ তরুণ দাশগুপ্ত নামে এক ছোট ভাই ছিলেন যিনি ভারতে ছিলেন। মায়ের শত অনুরোধ সত্ত্বেও বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি তিনি। বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কোন বংশধর ছিল না।
জানা যায় ভারতের কলিকাতা থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে তিনি কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে সহ-সম্পাদক হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’তে যুক্ত হন।
জানতে চাইলাম- আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ কয়টি। বললেন- শুধু দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটির নাম বললেন- ‘যুগপথিক কবি নবীন চন্দ্র সেন’। আর কোনটির নাম তিনি স্মরণে আনতে পারছিলেন না। অপ্রকাশিত কোন বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় অনেকটা আক্ষেপ করে বললেন- কবিতার বই একটির পাণ্ডুলিপি আমার থেকে একজন নিয়েছিল, কিন্তু পরে তা আর ছাপা হয়নি।
জীবনের আক্ষেপ বা অপ্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করায় বললেন- আক্ষেপ কি আর থাকবে? আর অপ্রাপ্তি বলতে কিছু নেই। প্রাপ্তি বলতে যা পেয়েছি তা হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাসই সবচেয়ে বড়। এর অমর্যাদা করতে নেই’। ‘আর আমার জীবনে মানুষের ভালোবাসাই আমার সবচাইতে বড় পাওয়া’।
যে জীবনে চাওয়ার সাথে পাওয়ার কোন সমীকরণ মেলানোর প্রয়োজন মনে করলো না, যে জীবনে শুধুই নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পরিশুদ্ধ সমাজজীবনের দীপশিখা হয়ে দীপ্যমান ছিলো- সে জীবনের শেষ পরিণতি কেমন হতে পারে তা নিয়ে কখনোই ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাঁর। জানি বার্ধক্যের কি যে যন্ত্রণা তা তিনিই একমাত্র উপলব্ধি করছেন।
জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেও বিত্তবৈভব তাঁকে টানেনি। আজীবন তিনি দেশ-সমাজ-জাতির আধুনিক বিনির্মাণে সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। ছিলেন নির্মোহ, প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী, সাহিত্যাঙ্গনের অকুতোভয় কলম সৈনিক ও সাদা মনের মানুষ। নিজের জীবন নিয়ে আক্ষেপ কিংবা নিজেকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতেন না। সার্বজনীন চিন্তা-চেতনার উদার মৈত্রীময় মানবতাবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি সমাদৃত ছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অজস্র প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রচুর লেখালেখিতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ও সৃষ্টি থাকলেও কোনপ্রকার স্বীকৃতি তাঁর মেলেনি। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনেক স্বীকৃতি তিনি পেলেও রাষ্ট্রীয় কোন পুরস্কার বা সম্মাননায় তিনি ভূষিত হতে পারেন নি।
এ মহান প্রথিতযশা সাংবাদিক-সাহিত্যিক-কবি অরুণ দাশগুপ্ত গতকাল (১০ জুলাই ২০২১) দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে যান। জীবদ্দশায় তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সম্মাননা অর্জন করতে না পারলেও আগামী প্রজন্মের কাছে চেতনার দীপশিখা হয়ে থাকার জন্য হলেও তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর প্রয়োজন বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবদ্দশায় কখনো অরুণ দাশগুপ্ত কারো মুখাপেক্ষী হননি, ধর্ণা দেননি কোন প্রাপ্তি বা সম্মাননার জন্য। আর তাই আজ এটা অরুণ দাশগুপ্তের দাবী নয়, এটা তাঁর অধিকার।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক, ‘অমিতাভ’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবর্ষার কদম ফুল
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের নগরের এক সুবাসিত কবি