জেলা-উপজেলায় লাফিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ৮ জুলাই, ২০২১ at ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিস্তার অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিতান্ত গ্রামাঞ্চলেও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সংক্রমণ। ফলে এ মহামারী প্রতিরোধে সরকারকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই দফায় দফায় জারি করতে হচ্ছে লকডাউন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে প্রশাসন বড় শহরগুলোতে যতটা কড়াকড়ি আরোপ করে উপজেলা পর্যায়ে তা সামান্যই অনুসরণ করা হয়। একদিকে জনসাধারণ নিজেদের খামখেয়ালি, অন্যদিকে প্রশাসনের কিছুটা ছাড় দেয়া মনোভাব- দুইয়ে মিলে জেলা-উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
সীতাকুণ্ড : সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সীতাকুণ্ডের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় সীতাকুণ্ডে সর্বোচ্চ ৪১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। গত এক সপ্তাহে মোট ১৫৬ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া মারা গেছেন চারজন। এদিকে সংক্রমণের দিক থেকে এ উপজেলা করোনার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই সচেতনতা পরিলক্ষিত না হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা হতাশ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার উপজেলা সীতাকুণ্ডে শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি। এরপরও এখানে তেমন জনসচেতনতা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তোয়াক্কা করছেন না অনেকে।
সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ সূত্রে জানা যায়, এ সময় পর্যন্ত এখানে মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৩২১ জন। গত এক সপ্তাহে ১৫৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া গত এক সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪ জন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুর উদ্দিন রাশেদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ফ্রি করোনা পরীক্ষা ঘোষণার পর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে করোনা পরীক্ষা সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়ে গেছে। তারপরও জ্বর, সর্দি ও কাঁশিতে যারাই আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা সময়ক্ষেপন না করে হাসপাতালে ফ্লু-কর্ণারে স্যাম্পল দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, এখানে করোনা দ্রুত ছড়াচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সকাল থেকে রাত অবধি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাস্তায় থেকে সাধারণ জনগণকে নিরাপদে বাড়িতে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় জনগণ অনেকটা আমাদেরকে পাহারা দিয়ে অহেতুক বাজারে উঠার চেষ্টা করে। আশানুরূপ সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। মানুষ একেবারে স্বাভাবিক সময়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজে যদি নিজের ভালো না বোঝে তাহলে তাদেরকে কি করে বোঝানো যাবে? করোনাকে অবহেলা না করে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, হাত ধোয়া ও মাস্ক ব্যবহারসহ নিয়মকানুন মেনে চলার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
রাউজান : রাউজান প্রতিনিধি জানান, উত্তর চট্টগ্রামে হু হু করে বেড়ে চলেছে করোনার সংক্রামণ। এই মহামারী থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারের জারি করা লকডাউনেও কমানো যাচ্ছে না সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। কঠোর লকডাউনেও হাট-বাজার, রাস্তাঘাটে মানুষের অবাধ চলাচলের কারণে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তারা মনে করেন লাকডাউন কার্যকর করতে এলাকায় এলাকায় তৎপর থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখনো মানবিক বিবেচনায় কঠোরতা দেখাচ্ছে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যার যার মত করে এখানে সেখানে বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন হাট-বাজারে ক্রেতা বিক্রেতারা ভিড় করছে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের উদাসীনতা লক্ষ্য করার মত।
জানা যায়, লকডাউন চলমান থাকলেও দক্ষিণ রাউজানের বাণিজ্যিক এলাকা নোয়াপাড়া পথের হাটে প্রায় ২০টি সরকারি বেসরকারি ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে। এসব ব্যাংকের সাথে লেনদেনে যুক্ত নারী-পুরুষরা যাওয়া আসা করছে নিয়মিত। এছাড়া প্রতিদিন যাওয়া আসায় রয়েছে গার্মেন্টস কর্মী ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা।
জানা যায় একই অবস্থা বিরাজমান হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়িতেও। গতকাল চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা তথ্যানুসারে ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১১ জনে।
হাটহাজারী : হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, হাটহাজারীতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল বুধবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে করোনা আক্রান্ত রোগীর ১০টি শয্যায় সমপরিমাণ রোগী ভর্তি করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসাইন জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের তথ্য মতে, গতকাল বুধবার ২৭ জন করোনা আক্রান্তসহ হাটহাজারতিে এ যাবত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১৫৩ জন। গতকাল পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে ২৪ জন।
করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে প্রথমবারের মত গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত ১০টি সিটের সবকটাতেই রোগী ভর্তি ছিল। এরপূর্বে এত রোগী আর কোনো সময় ভর্তি করা হয়নি। এতে বুঝা যায় এই উপজেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য লোকজনকে সচেতন হতে হবে। সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনা থেকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে অবস্থানের আপাতত কোন বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
লামা : লামা প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ী জনপদ লামায় বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণের হার। গত তিন দিনে এ উপজেলায় ১৫ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরী। সরকার ঘোষিত লকডাউনের মধ্যেও করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে স্থানীয়রা।
লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ সূত্রে জানা যায়, গতকাল ৭ জুলাই ১৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬ জন, ৬ জুলাই ১১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪ জন এবং গত ৫ জুলাই ৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়। এ উপজেলায় অদ্যবধি ৭২৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তার মধ্যে ১০২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৭৮ জন সুস্থ হয়েছেন। বর্তমানে ১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এবং ১০ জন হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের মধ্যে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের তিন নার্স, অফিস সহকারী ও এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন বলে জানা গেছে।
লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, লামায় প্রতিদিনই করোনার রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে ১০ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে। সেখানে বর্তমানে ১৪ জন ভর্তি আছে। লামায় বর্তমানে করোনা রোগীর সংখ্যা ২৪ জন। যাদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা কিছুটা আশংকাজনক। মনিরুজ্জামান বলেন, করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটা অত্যন্ত ছোঁয়াছে। ধারণা করছি যে, লামায় এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়াচ্ছে। তিনি করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সকলকে রোগ প্রতিরোধমূলক খাবার এবং ঔষধ খাওয়া, বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া এবং মাস্ক পরিধান করে সামাজিক দূরত্ব বজায় চলাফেরা করার পরামর্শ দেন।
এদিকে, বুধবার বিকালে অনুষ্ঠিত ‘করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির এক সভায় লামায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনে আরো কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত হয়।
সন্দ্বীপ : কঠোর লকডাউনের মধ্যেও চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে কোভিড পজিটিভের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ৪ জুলাই থেকে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে (হারামিয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল) শুরু হয়েছে র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট। গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ ৪ দিনে ৩১ জন সন্দেহভাজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। যাতে ১৮ জনেরই কোভিড পজিটিভ আসে। এছাড়া ৪ জুলাই চট্টগ্রামের বিটিআইতে ৬ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়। এরমধ্যে ৫ জনের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। সবমিলিয়ে গত ৪ দিনে সন্দ্বীপে ৩৭ জনের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৩ জন।
সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম বলেন, আমরা এ মুহূর্তে কোভিড-১৯ এর শেষ পর্যায়ে আছি। করোনা সংক্রমণ সামাজিক পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছে। র‌্যাপিড এন্টিজেন্ট টেস্টের মাধ্যমে যে ফলাফল আমরা পাচ্ছি তা বেশ উদ্বেগজনক। তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে প্রত্যকের স্ব স্ব অবস্থান থেকে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। অযথা বাইরে ঘুরাঘুরি পরিহার করতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারত থেকে আসা নারী শিশুসহ ৭ রোহিঙ্গা আটক
পরবর্তী নিবন্ধএস কে সুর ও তার স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত