বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ৫ জুলাই, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদী এবং আমি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকার সময় প্রতিদিন সকালে হকার আমার বাসায় দৈনিক আজাদী পত্রিকা দিয়ে যেতো। সকালে দৈনিক আজাদী পড়া আমার পুরানো অভ্যাস। আজাদী পড়ার পর আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্যান্য দৈনিকগুলোও পড়তাম। ঘুম থেকে উঠে ড্রইংরুমে আজাদী পত্রিকা দেখতে না পেলে আমি পত্রিকার হকারকে ফোন করতাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাসাটা কিছুটা পাহাড়ের উপরের দিকে হওয়ায় হকার সাইকেল চালিয়ে উঠতে পারতো না। মাঝে মাঝে ফাঁকি দিতো। আমার বাবা দৈনিক আজাদী পত্রিকা পড়তেন। আজাদী পড়া আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পাঠানটুলি এলাকায় আমাদের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ কাম টিন কন্টেইনার ফ্যাক্টরী কাম স্টিল ফার্নিচারের ওয়ার্কশপ ছিল। আমার বাবা এবং আমার জ্যাঠা দুই ভাই ১৯৫৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের ওয়ার্কশপে একটি ঝালাই সেকশন ছিল। সেখানে বেশ কয়েকজন মিস্ত্রি কাজ করতো। সকাল বেলা অফিসে এসে আমার জ্যাঠা আজাদী নিয়ে বসতেন। আজাদী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে উনি এই পত্রিকার পাঠক। তারপর শুরু করতেন ইত্তেফাক পড়া। উনি ব্যাংক এবং বিভিন্ন কাস্টমারের অফিসে যাতায়াত করতেন। তখন আমার বাবা চোখের সামনে আজাদী পত্রিকা খুলে বসে থাকতেন। কি পড়তেন আল্লাহ্‌ জানে। একদিন আমি কলেজ হোস্টেল থেকে আমাদের ফ্যাক্টরীর অফিসে গিয়ে দেখি আমার বাবা ঝালাই মিস্ত্রি গোপালকে উনার পাশের চেয়ারে বসিয়ে আজাদী পত্রিকা পড়তে দিয়েছেন। গোপাল লেখাপড়া জানতো। সে আজাদী পড়তে চাইতো বলে আমার বাবা তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। আমার বাবা জীবনের শেষ অংশে এসে যখন বিভিন্ন রোগে শয্যাশায়ী তখন একদিন দামী গাড়িতে চড়ে অনেক উপঢৌকনসহ আমার বাবাকে দেখতে এসেছিলেন এক লোক। সে হচ্ছে আমাদের মিস্ত্রী গোপাল। পরবর্তীকালে সে দুবাইতে কারখানা স্থাপন করে এবং অনেক টাকার মালিক হয়। তাকে দেখে আমার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলতে থাকেন গোপাল, আমি এখন আর আজাদী পড়তে পারি না, শরীর কাঁপে।
রাশেদ রউফ যখন দৈনিক আজাদীর বৃহস্পতিবারের বিশেষ পাতা ‘আনন্দন’ দেখাশোনা করতো তখন একদিন রাশেদ আমাকে বলে, স্যার, আপনাকে আনন্দনের জন্য একটা ধারাবাহিক লেখা দিতে হবে। লেখাটির শিরোনাম হবে ‘আমার জীবন’। এটি হবে একটি আত্মজীবনীমূলক লেখা। আপনি বাল্যকালের স্মৃতি থেকে শুরু করবেন। তখনকার সময়ে আনন্দনের মাসিক চারটি পাতার মধ্যে দুইটি দেখাশোনা করতো জহুর এবং দুইটি পাতা দেখাশোনা করতো রাশেদ। তখনকার দিনে লেখা ছাপার সময় লেখকের ছবি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। কারণ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ছিল। আজকের মতো আমরা অনলাইনে পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম না। আমাদের হাতে এনড্রয়েড ফোন এবং ল্যাপটপ ছিলোনা। গ্রামীণফোন, রবি এসব অপারেটরও ছিলোনা। কিন্তু রাশেদ ‘আমার জীবন’ নামক আনন্দনে প্রকাশিত ধারাবাহিক লেখায় আমার ছবি দিয়ে গেটআপ অনেক উন্নত করেছিল। দু’এক কিস্তির লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরে আমাদের এলাকার লোকজন আমার বাসায় আসতে শুরু করলো। এসেই ওদের এবং আমার বাল্যকালের কমন স্মৃতি নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। একদিন কাজী নুর মোহাম্মদ জুনু এবং খাজা আহমদ চিশতী আমার বাসায় এসে আমাকে বললো বদ্দা, তোমাকে এখনই আমাদের সাথে যেতে হবে। আমি বললাম কোথায়? তারা দুজনই বললো তুমি আনন্দনে লিখেছো, তোমাদের বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে মুন্সীপাড়া এলাকায় রেলের যে ইয়ার্ড আছে তার ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তোমরা দলবেঁধে স্কুলে যেতে। তখনকার যুগে রেলের আধুনিক ইঞ্জিন ছিলো না। ছিলো কালো রঙের বিশাল কয়লার ইঞ্জিন। ঐ স্টীম ইঞ্জিনের বয়লার থেকে যখন কালো ধোঁয়া বের হতো তখন পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যেতো। তোমাদের বন্ধুরা সে ধোঁয়ার ভিতর ঢুকে সিগারেটের পরিবর্তে মুখ ও নাক দিয়ে ধোঁয়া টানতো। আর ধোঁয়ার ভিতর থেকে যখন তারা বেরিয়ে আসতো তখন তাদের সাদা জামা কালো হয়ে যেতো।
আমি মাঝে মাঝে কাট্টলীর ফইল্যাতলী বাজারে-বাজার করতে যেতাম। একদিন মুদির দোকানে লম্বা একটা ফর্দ দিয়ে কাঁচা বাজারে ঢুকলাম। যাওয়ার সময় মুদির দোকান থেকে মাল নিয়ে যাবো এই কথা মুদির দোকানের মালিককে বললাম। বাজার শেষ করে যখন মুদির দোকানে আসি দোকানদার বললো আপনি কিছুক্ষণ বসুন। তার মানে আমার মাল মাপা হয় নাই। আরো কিছুক্ষণ পর আমি বার বার তাগাদা দেওয়ার পর দোকানদার তার কর্মচারীকে বললো স্যারের মালগুলো প্যাকেট করেছো? ছেলেটি বললো না। আমি অবাক হলাম। এরা আমাকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছে। মুদির দোকানে মাল প্যাকেট করার জন্য পুরানো খবরের কাগজ থাকে। কর্মচারীটি কাগজের একটি ছেঁড়া অংশ হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বললো স্যার এই ছবিটি কি আপনার? আমি অবাক হয়ে দেখলাম এটি আজাদীর একটি ছেঁড়া পৃষ্ঠা এবং পৃষ্ঠাটি আনন্দনের। ঐ পৃষ্ঠায় আমার কলাম ‘আমার জীবন’ ছাপা হয়েছে। আমি বললাম, হ্যাঁ। সে বললো আপনি যখন আমাকে স্লিপ দিয়ে যান তখনই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আপনার সাথে কথা বলার আগ্রহের কারণে আমি মালপত্র প্যাকিং না করে আপনাকে বসিয়ে রেখেছি। আমি পেটের দায়ে দোকানে চাকরি করি। কিন্তু আমি লেখাপড়া জানি। আপনার কলাম পড়ি। লেখাটি আমার খুব ভালো লাগে।
এই কথা বলে, আমি এতোক্ষণ ধরে পাঠকদের কাছে বুঝাতে চাইলাম, অনেক মানুষ অভ্যাসবশত দৈনিক আজাদী পড়ে। তাদের কাছে চাঁটগা এবং আজাদী প্রায় সমার্থক। হতে পারে এই ক্যারিশিমা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেকের কিংবা অধ্যাপক খালেদের। এই কথাগুলো ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর জন্মদিন উপলক্ষে লিখলে প্রাসঙ্গিক হতো। কিন্তু এতো আগে এ ধরনের কথা বলার পেছনে দুটি কারণ আছে। ১) ২০১৯ সালের শেষের দিকে আমি মাথায় এবং চোখে আঘাত পেয়ে হায়দ্রাবাদে যাই এবং অপারেশনের পর দেশে আসি। পুনরায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাই। সেখান থেকে আসার পর করোনার দাপটে বাংলাদেশ এবং ভারতসহ সারাবিশ্ব বিপর্যস্ত হয়। আমি আর চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পারিনি। এখনও যেতে পারছি না। দেশে যে বিশেষজ্ঞ আমাকে দেখতেন তিনি অনেকদিন ধরে আমেরিকাতে আটকা পড়েছিলেন। আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকি। আমার শরীরে নানারকম অসুখ বাসা বাঁধে। আমি খুবই হতাশ। আর কতদিন বেঁচে থাকবো সেটা অনিশ্চিত। তাই আমি আজাদীর প্রতি আগেভাগে আমার স্মৃতি থেকে কৃতজ্ঞতার কথাগুলো বললাম। ২) একজন লোক আমাকে ফোন করেছিলেন, তিনি বললেন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক আব্দুল মালেক সাহেবের উপর এই ভদ্রলোক একটি বই বের করবেন। সে বইয়ে আমাকে একটি লেখা দিতে হবে। আমি তাঁকে বললাম, আপনি যদি মালেক সাহেবের উপরে বই লেখেন তাহলে উনার জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আপনি বইটি বের করুন। বিভিন্নজনের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে যদিও আপনি বই বের করেন তাহলে সেটি তো আপনার বই হবে না। সেটি হবে আপনার সম্পাদিত গ্রন্থ। আমাকে যদি আল্লাহ্‌ সুযোগ দেয়, আমি নিজে তথ্য সংগ্রহ করে একটি বই লেখার চেষ্টা করবো। ইঞ্জিনিয়ার খালেক, অধ্যাপক খালেদ এবং আব্দুল মালেক সম্পর্কে আমি অনেক তথ্য জানি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় মালেক সাহেব বলেছিলেন আমি টাকা রোজগার করার জন্য দৈনিক আজাদীতে এতো শ্রম দিই না। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একটি ‘কাগজ’ বের করেছিলেন, আমি যদি সেই কাগজকে টিকিয়ে রেখে সমৃদ্ধ করতে না পারি তাহলে লোকে বলবে আমি কেমন সন্তান? তাই আজাদী আমাদের কমিটমেন্ট। তিনি বলেছিলেন আপনারা বড়ো বড়ো শিক্ষিত লোকেরা আজাদীতে লিখতে পারেন, যেমন, এখানে অধ্যাপক ফজলুল হক সাহেব আছেন উনি নিয়মিত আজাদীতে লিখেন। মালেক সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকটি হলো, উনি কমার্স কলেজের ছাত্র, আমি একই কলেজের ছাত্র, উনি আমার সিনিয়র। আমি যখন কমার্স কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করি, উনি আজাদীর ফটোগ্রাফার এবং সাংবাদিকদের নিয়ে আমার অফিসে গিয়ে আমাকে সংবর্ধিত করেছিলেন। আমি সুপারিশ করায় উনি কমার্স কলেজের গরীব ছাত্রদের প্রতি বছর আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। উনার ছেলেমেয়েরা আমার ছাত্র। সুতরাং উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে আজাদী সম্পাদক আব্দুল মালেক কেমন মানুষ? চট্টগ্রামের জন্য কি তাঁর অবদান? আমার উত্তর হবে এইরকম, আপনি গাছকে প্রশ্ন করুন তোর পরিচয় কি, সে বলবে ফলে আমার পরিচয়। তুমি আমার ফলটা দেখো। এটা কি আম? এটা কি কাঁঠাল? ফল-এ আমার পরিচয়। আপনি মালেক সাহেবের অনেক ভালো ভালো কাজের হদিস পাবেন না। অনেক ভালো কাজ তিনি গোপনে করেন। যেমন তিনি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেন এটা অনেকেই জানে না। এরকম আরো অনেক কাজ আছে। কিন্তু এই করোনাকালেও আপনি দৈনিক আজাদীকে দেখুন ফল ও ফুল যেমন গাছের ঢাল থেকে সৌরভ ছড়ায়, আজকের আধুনিক দৈনিক আজাদীও তেমন সৌরভ ছড়াচ্ছে। আজাদীর কারণে মালেক সাহেব ইতিমধ্যেই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নন্দিত হয়েছেন। কিন্তু তার অনেকগুলি ‘বাতেনি’ কৃতিত্ব আছে, হয়তো আপনারা একদিন সব জানতে পারবেন। আশা করি, যিনি আমার কাছে মালেক সাহেবের উপরে গ্রন্থ বের করার জন্য একটি লেখা চেয়েছিলেন, তিনি অনুভব করতে পারবেন পাঁচশো/সাতশো শব্দের মধ্যে বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী আব্দুল মালেকের জীবনী লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মালেক সাহেব অনেক বিনয়ী, উঁচু ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। চট্টগ্রামের মানুষের জন্য দৈনিক আজাদী এবং মালেক সাহেবের অবদান পরিমাপ করা কঠিন কাজ।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীর পুতা বেগুন : একটি সম্ভাবনাময় সব্জি ফসল
পরবর্তী নিবন্ধচীনা মহাকাশ স্টেশনে হাঁটছেন নভোচারীরা