পাঁচলাইশ মোড়। গতকাল রোববার বেলা ১২ টা। আনুমানিক ২৫ বছরের দুই তরুণ রিকশা করে যাচ্ছিলেন। একজনের মুখে মাস্ক ছিল না। লকডাউন সফল করতে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের রিকশা থামিয়ে প্রশ্ন করেন, কোথায় যাচ্ছেন? আমতা আমতা করে তাদের একজন বললেন মেডিকেল। তবে রোগী কে বা কোন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন তার উত্তর দিতে পারেনি। পরে মাস্কবিহীন তরুণকে মাস্ক পরার নির্দেশনা দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এ দৃশ্য থেকেই স্পষ্ট হয়, কঠোর লকডাউনে সরকারি বিধি নিষেধ অমান্য করে রাস্তায় বের হওয়ার জন্য নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন লোকজন। এর মধ্যে মেডিকেল যাওয়া, ওষুধ কেনা, কেউ বাজার করার নামেও বের হচ্ছেন। তবে টহলরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারলে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের চতুর্থ দিন ছিল গতকাল। লকডাউন সফল করতে মাঠে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও জেলা প্রশাসন। সিটি কর্পোরেশনের দুইজন ম্যাজিস্ট্রেটও দায়িত্ব পালনকালে জরিমানা করেন। এদিকে জেলা প্রশাসনের ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলায় ১৬ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা করেছেন। এর মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা জান্নাত ডবলমুরিং ও বন্দর এলাকায় ৪টা মামলায় ৬০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। পাহাড়তলি ও আকবরশাহ এলাকায় মোহাম্মদ আতিকুর রহমান একটি মামলায় ২০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকায় আশরাফুল হাসান ৮টি মামলায় ৬ হাজার ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। পাঁচলাইশ এলাকায় মো. জিল্লুর রহমান ৫টি মামলায় এক হাজার ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। বায়েজিদ ও খুলশী এলাকায় নাঈমা ইসলাম ৬টি মামলায় ৮০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। নূরজাহান আক্তার সাথী হালিশহর এলাকায় ২টি মামলায় ১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। হালিশহর এলাকায় প্লাবন কুমার বিশ্বাস ৩টি মামলা দায়ের করে এক হাজার ২০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। চান্দগাঁও এলাকায় প্রতীক দত্ত চারটি মামলায় এক হাজার ৪৫০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। কোতোয়ালি ও সদরঘাট এলাকায় আবদুল্লাহ আল মামুন ছয় মামলায় এক হাজার ৯০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন। এছাড়া হুছাইন মুহাম্মদ পাঁচ মামলায় এক হাজার ৮০০ টাকা অর্থদণ্ড আদায় করেন।এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁিক দিয়ে রাস্তায় বেরুনোর চেষ্টা ছিল লোকজনের।
গতকাল দিনভর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সকালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে লোকজন ছিল কম। তবে সময় বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে চলাফেরা। এছাড়া অলিগলিতে ছিল যথারীতি ভিড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে ছিল বিরতিহীন আড্ডা। মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক পরার প্রবণতাও ছিল কম।
এদিকে শহরের মার্কেট ও শপিং মল ছিল বন্ধ। খোলা ছিল হোটেল-রেস্তোরাঁ ও কাঁচাবাজার। তবে অলিগলিতে খোলা ছিল সব ধরনের দোকানপাট। অবশ্য মাঝে মধ্যে টহল পুলিশ দেখলে বন্ধ করে দেন। পুলিশ চলে যেতেই আবারো খোলা হয়। রাস্তায় গণপরিবহন চলেনি। তবে প্রচুর প্রাইভেট গাড়ি ও রিকশা ছিল।
এদিকে চকবাজার, কোতোয়ালী, সদরঘাট, বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড, বায়েজিদ বোস্তামীসহ বিভিন্ন এলাকায় সেনবাহিনীকে টহল দিতে দেখা গেছে।
বিকলে চকবাজার তেলিপট্টি মোড়ে দেখা গেছে, ক্যাপ্টেন সাবিহা সুলতানার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন যানবাহন ও পথচারীদের থামিয়ে কোথায় এবং কেন যাচ্ছেন জানতে চান। একইভাবে মোটর সাইকেল থামিয়েও জানতে চান। উপযুক্ত কারণ বলতে পারলে যেতে দেন। অন্যথায় ঘুরিয়ে দেন। এসময় মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি অহেতুক ঘুরাফেরা না করার জন্য লোকজনকে আহবান জানান।
দেখা গেছে, একটি রিকশায় দুইজন মহিলা যাত্রী ছিলেন। তাদের একজনের মুখে মাস্ক ছিল না। রিকশা থামিয়ে সেনাবাহিনী মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে ওই যাত্রী তার ব্যাগে মাস্ক রয়েছে বলে জানান। মাস্ক পরার পর ওই যাত্রীকে চলে যেতে দেয়া হয়।
ক্যাপ্টেন সাবিহা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, করোনার নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে প্রচুর সংক্রমণ বেড়ে গেছে। তাই সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে যত বিধিনিষেধ আছে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি আমরা।
তিনি বলেন, কিছু লোক সরকারি নির্দেশনা মানছেন। অনেকে বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করছেন। আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করছি। যারা মাস্ক পরেনি তাদের মাস্ক পরতে উৎসাহিত করছি। অপ্রয়োজনে যারা ঘুরাফেরা করছেন তাদের বাসায় চলে যেতে বলছি। মোটামুটি মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। এখন তারা যদি বুঝতে পারে আমাদের উদ্দেশ্যটা পূরণ হবে।
দায়িত্ব পালনকালে পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে বলেন, ইয়ং জেনারেশন প্রয়োজন ছাড়াই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বিকেলে বাতাস খেতে বের হচ্ছে। কেন বের হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তারা সঠিক কারণ বলতে পারে না। তাদের বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। এছাড়া অন্যদের বেশিরভাগই মেডিকেল রিজন দেখাচ্ছে। তবে ভেরিফাই করে সত্যতা ফেলে ছেড়ে দিচ্ছি। অন্যথায় তাদের মোটিভেট করছি।
চকবাজারে ফয়েজ নামে বয়স্ক এক পথচারী বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলে এক নিকটাত্মীয় ভর্তি আছেন। তাকে দেখতে যাচ্ছি। লকডাউন সফল করতে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি। বিকেল ৩ টায় চকবাজার কাঁচা বাজারে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের মত ক্রেতার ভিড়। কারো মুখে মাস্ক ছিল, কারো ছিল না।
খাবার, মুদি দোকান ও কাঁচবাজার ছাড়া অন্যসব দোকানপাট বন্ধ থাকার নির্দেশনা আছে লকডাউনে। অথচ অন্যান্য দোকানপাটও খোলা দেখা গেছে গতকাল। চকবাজার গোলজার এলাকায় বেশ কয়েকটি কম্পিউটার ও পার্টস বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, ইজি লোড এবং লাইব্রেরিও খোলা ছিল। শহরের অন্যান্য জায়গায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। জামালখানে বেশ কয়েকটি চশমার দোকান খোলা দেখা গেছে।
ডিসি রোড চান মিয়া মুন্সি লেইন এলাকার বাসিন্দা রাজু বলেন, প্রায় সব দোকান খোলা ছিল। খাবার হোটেলের পাশাপাশি কসমেটিকস, ইজিলোড, মুদি দোকান খোলা ছিল। তবে পুলিশ দেখলে বন্ধ করে দেয়। চলে যেতেই আবার খোলা হয়। বিভিন্ন চায়ের দোকানে আড্ডাও ছিল।
দামপাড়া এক নম্বর গলির বাসিন্দা শহীদ বলেন, সারাদিন দোকানপাট খোলা ছিল। চায়ের দোকানে বসে নাস্তা করছেন অনেকে। দেখে মনে হয়েছে সব কিছু স্বাভাবিক। বহাদ্দার ফরিদারপাড়া তালতলা এলাকার বাসিন্দা নজরুল বলেন, বহাদ্দারহাট মোড়ে দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে গলির ভেতর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল।
বিকেলে হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ মাঠে দেখা গেছে, ফুটবল খেলছেন একদল তরুণ। জামালখানে ছিল আড্ডা। মোগলটুলী, কদমতলী, রাজাপুকুর লেইন, এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর মানুষ দেখা গেছে।
এদিকে খোলা ছিল পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কলকারখানা। সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় শাখা খোলা ছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ কারখানার ছিল না নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। আবার চলেনি গণপরিবহন। এতে দুর্ভোগে পড়েন শ্রমিকরা।