সবুজ পাহাড়ের মাঝ বরাবর নতুন সড়ক। দুই পাশে উঁচু পাহাড়ের উপর মেঘের হাতছানি। বৃষ্টির পর এসব পাহাড় ছুঁড়ে মেঘ বয়ে যায়। দুই পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে কালো পিচঢালা সড়ক। উঁচু পাহাড়, দূরে মেঘের হাতছানি ও উপত্যকা দেখার জন্য এ সড়কে ভিড় করছে ভ্রমণ পিপাসুরা। সাড়ে ২২ কিলোমিটার সড়ক পাল্টে দিচ্ছে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনপদের দৃশ্যপট।
সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। পর্যটন ও সড়ক যোগাযোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি সড়ক। এই মুহূর্তে পাহাড়ের ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম গন্তব্য এই সড়ক। পর্যটকদের মনের তৃষ্ণা মেটালেও স্থানীয়দের কাছে এই সড়ক এখন ‘প্রাণ প্রবাহ’। জালিয়াপাড়া থেকে সিন্দুকছড়ি হয়ে মহালছড়ি পর্যন্ত এই সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। এই সড়কে সিন্দুকছড়ি, পঙ্খীমুড়া, ধুমনিঘাটসহ বেশ কয়েকটি জনপদ রয়েছে। এসব এলাকায় অন্তত ২০ হাজার মানুষের বসবাস। সড়ক নির্মাণের আগে এসব এলাকার মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। কাঁচা সড়ক থাকলেও তা চলাচলে অনুপযোগী। কাদামাটি পেরিয়ে এসব সড়কে চলাচল করত স্থানীয় গ্রামের মানুষ। কৃষিজ ও বনজ পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি ছিল। এছাড়া অনেকে ফলদ বাগান গড়ে তুললেও ফল পরিবহনের ভোগান্তি পোহাতে হতো। শিক্ষার্থীরা পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করত। মহালছড়ি উপজেলা সদরে পৌঁছাতে সময় লাগত ১ থেকে দেড় ঘণ্টা। শুষ্ক মৌসুমে মোটরসাইকেল চলাচল করলেও বর্ষায় যোগাযোগ বন্ধ থাকত। তবে সেসব দিন পেরিয়ে নতুন সড়কে চলাচল করছে স্থানীয়রা। নতুন সড়কের কারণে মহালছড়ি ও রাঙামাটির দূরত্ব কমেছে। রাঙামাটি থেকে ঢাকার দূরত্ব কমেছে ৬৮ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহর না ঘুরেই মহালছড়ি সিন্দুকছড়ি হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করা যাবে। এতে সময় কমবে প্রায় তিন ঘণ্টা। মহালছড়ির পঙ্খীমুড়া এলাকার জুমচাষি সুমন ত্রিপুরা ও পূর্ণ ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এখানে আগে মাটির রাস্তা ছিল না। কোনো যানবাহনও চলাচল করত না। এক ঘণ্টার বেশি সময় হেঁটে মহালছড়ি বাজারে যেত হতো। এখন তো গাড়ি চলাচল করছে। মোটরসাইকেলে বাজারে যেতে সময় লাগছে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। গ্রামের মানুষ এখন সহজেই এ সড়ক ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবে।
মহালছড়ি ফল বাগান মালিক সমিতির সভাপতি হ্ল্যাশিমং চৌধুরী বলেন, আমি ধুমনিঘাট এলাকায় বাগান করেছি ছয় বছর আগে। তখন রাস্তা ছিল না। বর্ষায় হেঁটে আসা-যাওয়া করতাম। ফল কাঁধে করে নিয়ে যেতাম। রাস্তা ভালো না থাকায় ব্যবসায়ীরা বাগান থেকে পণ্য কিনতে অনীহা প্রকাশ করত। রাস্তাটি নির্মিত হওয়ার পর এখানে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে আসে।
নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই কাজ শেষ করেছে সেনাবাহিনী। আর এই সড়ককে ঘিরে সহজ যাতায়াত, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয়রা। প্রথম পর্যায়ে ৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়া পর দ্বিতীয় পর্যায়ে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো সড়কে ১১টি কালভার্ট, ৬৩০ মিটার ধারক দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ধস ঠেকাতে বর্ষায় পাহাড়ের পানি দ্রুত সরিয়ে নিতে দেওয়া হয়েছে ক্রস ড্রেন।
মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কর্মকর্তা মেজর এস এম খালেদুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টির সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। বর্ষায় পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকে। ধস ঠেকাতে রাস্তার উভয় পাশে আমরা সাইড ড্রেন নির্মাণ করেছি। এতে রাস্তা ঠেকসই হবে। গুণগত মান শতভাগ ঠিক রেখে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস আগেই নির্মাণ কাজ শেষ করেছি।
সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পাহাড়ে জুম চাষ হয়। জুমের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি পোহাতে হতো। সড়কটি নির্মাণ হওয়ায় দ্রুত পণ্য পরিবহন করতে পারবে।











