পরিচয় তার বন্দরের ঝাড়ুদার করেন নগরজুড়ে ছিনতাই

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৬ জুন, ২০২১ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বন্দরে অস্থায়ী ভিত্তিতে ঝাড়ুদারের চাকরি করে সে। আবার স্ত্রী ও মামার সমন্বয়ে গ্রুপ তৈরি করে ছিনতাইও। এই মামা নিজেকে কখনো পুলিশের সোর্স, কখনো আবার সরকারি দলের নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। কখনো মামার উছিলায় জায়গাতেই ছাড়া পেয়ে যায়। কখনো চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকলে বের করে আনে তার স্ত্রী।
নাম তার আকাশ (২৩)। মূলত দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা তার ছিনতাইয়ের সীমানা হলেও নগর জুড়েই তার বিচরণ। গত তিন বছরে তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছে। প্রতিবারই জামিনে বেরিয়ে আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে। তবে জেলে গেলেও বেরিয়ে এসে আবারও বন্দরের অস্থায়ী
চাকরি সে ফিরে পেয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ আকাশসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার বাকি তিনজন হলো আকাশের স্ত্রী তানিয়া বেগম (২৫), সৎ মামা তাজুল ইসলাম (৪০) এবং ছিনতাইকারী গ্রুপের কথিত গডফাদার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এসময় উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১১টি মোবাইল, ১৬টি লেডিস ব্যাগ এবং ৮ পিস হীরা ও নগদ ২০ হাজার টাকা।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, আকাশ ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ছিনতাই করে পালিয়ে যেতে পারে। এসময় যাত্রী টের পেয়ে গেলে তাকে ছুরিকাঘাতের ভয় দেখায়। পাশাপাশি সন্ধ্যার পর গার্মেন্টস ছুটির সময় নারী এবং বাস, ট্রাক ও কভার্ডভ্যানের চালক, হেলপার কিংবা জানালার পাশে বসা যাত্রীদের টার্গেট করেও আকাশ ছিনতাই করে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত রমজানে আকাশ সিএনজি টেক্সির চালের পর্দা কেটে এক তরুণীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই করে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশ আকাশকে শনাক্ত করে এবং গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ জানিয়েছে, বুস্টার জামাল, বুলেট রমজান এবং আকাশ- তিনজন মিলে ছিনতাই করে। আকাশই দল নেতা। তাদের গ্রুপসহ একাধিক গ্রুপের গডফাদার আনোয়ার। আনোয়ার নিজেকে পুলিশের সোর্স পরিচয় দেয়। আবার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েও প্রভাব খাটায়। মূলত সেই এসব ছিনতাইকারীদের শেল্টার দেয় এবং ভাগ নেয়।
আকাশের স্বীকারোক্তি মতে, আনোয়ারা উপজেলার বরুমছড়ায় তার বাড়ি। বর্তমানে থাকে পতেঙ্গার বড় মসজিদ কন্ট্রোল মোড় এলাকায়। সে গত তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬ হাজার টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের চাকরি করে। ৫-৭ বছর ধরে ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। প্রথমে ফারজানা নামে আগ্রাবাদের এক গ্যাং লিডারের গ্রুপে ছিল। তার সাথে বিরোধ দেখা দিলে বছরখানেক ধরে নিজেই তিনজন নিয়ে একটি গ্রুপ গড়ে তুলেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডবলমুরিং থানা পুলিশের হাতে সে ধরা পড়ে। রমজান মাসে জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসে। স্ত্রী তানিয়া তাকে প্রতিবার গ্রেপ্তারের পর জামিন করিয়ে আনে।
ছিনতাইয়ের কৌশল সম্পর্কে আকাশ বলেন, টার্গেট থাকে গার্মেন্টসের মহিলা, বাস-ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি টেক্সি। টেক্সি জ্যামে পড়লে পেছন দিকে উঠে চালের পর্দা কেটে বড় ছোরা ঢুকিয়ে দিই। তখন যাত্রী ভয় পেয়ে যায়। মহিলা যাত্রী থাকলে সুবিধা। ভয় দেখিয়ে মোবাইল, টাকা, ব্যাগ কেড়ে নিই। আবার বন্দর থেকে বের হওয়া বাস-ট্রাকের চালক-হেলপারকে বলি, পেরেক ঢুকে চাকা পাংচার হয়ে গেছে। তখন তারা গাড়ি থামিয়ে দ্রুত চাকা পরীক্ষা করতে নামে। হাতে মোবাইল থাকলে কেড়ে নিই। এছাড়া অনেক গার্মেন্টসের মেয়ে অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে বাসায় যায়। তাদের একা অন্ধকার রাস্তায় পেলে আটকে মোবাইল কেড়ে নিই। পাশাপাশি জানালার পাশে বসা কোনো যাত্রী ফোনে কথা বললে চোখের পলকেই সেটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যায় আকাশ! আকাশের ভাষ্যমতে, গত তিন বছরে কমপক্ষে ৩০০ মোবাইল সে ছিনতাই করেছে। তারা তিনজন কখনও একসঙ্গে, আবার বেশিরভাগ সময় আলাদাভাবেও ছিনতাই করে। যাতে একজন ধরা পড়লে অন্যরা সহযোগিতা করতে পারে।
আকাশ জানায়, গত রমজানে ছিনতাই করা এক নারীর ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরে ৮টি হীরার পাথর পায়। কিন্তু চিনতে না পেরে সে তার সৎ মামা তাজুলকে সেগুলো রাখতে দেয়। যদি বিক্রি করতে পারে, ভাগ দেওয়ার কথাও বলে। কিন্তু তাজুল তাকে সেগুলো যে হীরার পাথর সেটা জানায়নি। মাত্র দুইটি তার স্ত্রীকে দিয়ে বাকিগুলো তাজুল ও আনোয়ার মিলে আত্মসাত করে। অজ্ঞতার কারণে আকাশ এক লাখ ২০ হাজার টাকা দামের একটি মোবাইল সেট মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে বলেও জানিয়েছে। অভিযান পরিচালনাকারী এসআই অর্ণব বড়ুয়া জানান, অভিযানে উদ্ধার করা আটটি হীরার পাথরের মধ্যে দুইটি পাওয়া গেছে আকাশের স্ত্রী তানিয়ার কাছে। বাকিগুলো আনোয়ার ও তাজুলের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে।
আনোয়ার ও তাজুল সম্পর্কে আকাশ বলেন, তাজুল আমার সৎ মামা। আমি ছিনতাই করি উনি জানেন। কিন্তু উনি ছিনতাই করেন না। মাঝে মাঝে ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রি করে সহযোগিতা করেন। আনোয়ার হোসেন পলিটিক্স করেন। আমরা ঝামেলায় পড়লে উনি হেল্প করেন। ছিনতাই করা মোবাইল-টাকা পয়সা থেকে আমরা উনাকে ভাগ দিই।
ওসি জানান, আকাশের ছিনতাইয়ের আদ্যোপান্ত তার স্ত্রী তানিয়া জানে। তানিয়া সবকিছু জেনেই বয়সে ছোট আকাশকে বিয়ে করেছে। এমনকি স্বামীর অপকর্মে সহযোগিতাও করেছে। আকাশ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই করার পর কিছু অংশ আনোয়ার ও তাজুলকে দিয়ে বাকিগুলো তানিয়ার কাছে এনে জমা রাখে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাল-ডালে অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার
পরবর্তী নিবন্ধচসিকের কাছে ‘তথ্য গোপনে’র ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়