পৌরকর : মেয়র সমীপে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২২ জুন, ২০২১ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। নগরবাসীর অবস্থাও হয়েছে তেমন। নাগরিকদের সমস্যা ও দুর্ভোগ লাঘবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পৌরকর সংক্রান্ত দুটো প্রস্তাবের কারণেই শঙ্কিত নগরবাসী। গত ৩ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চসিক প্রস্তাব করে, পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নে ২০১৭ সালের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায় করার। অথবা স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করার।
ভবন মালিকদের শঙ্কা, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে সেই ‘অতিরিক্ত’ কর পরিশোধ করতে হবে তাদের। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে নানা কারণে আর্থিক সক্ষমতা কমেছে ভবন মালিকদের। এ অবস্থায় পৌরকরের হার বাড়লে তা তাদের জন্য অসহনীয় হবে। এ বিষয়ে নাগরিক মতামত আহ্বান করে দৈনিক আজাদী। এতে সাড়া দিয়ে যারা আমাদের ইমেইলে ‘নাগরিক মতামত’ পাঠিয়েছেন, তাদের মতামত আমরা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করব। আশা করছি, সিটি মেয়র নাগরিক মতামত বিবেচনায় নেবেন। আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় কিস্তি।

মুহাম্মদ নঈমুল ইসলাম
চসিকের প্রস্তাব অযৌক্তিক
গণমাধ্যম মারফত জানলাম, ২০১৭ সালে স্থগিত পঞ্চবার্ষিক কর রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরু করতে চায় সিটি কর্পোরেশন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে সম্প্রতি চসিক দুটো প্রস্তাব দিয়েছে; যার প্রথমটি হলো, ২০১৭ সালের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে পৌরকর আদায়। এটা চসিকের অযৌক্তিক প্রস্তাব। তৎকালীন সময়ে অশুদ্ধ পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা গৃহকর জনগণের অসহনীয় মনে হয়েছিল বলে তারা তা বর্জন করে। এভাবে গৃহকর নেওয়া অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে জনগণ আন্দোলন করেছিল। ২০১৭ সালে সরকার গৃহকর নেওয়ার এই প্রক্রিয়া স্থগিত করে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, স্থগিতাদেশ বাতিল করে পুনরায় অসহনীয় মাত্রায় গৃহকর নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে জনগণ এবারও তা বর্জন করবে এবং পুনরায় আন্দোলনে নামতে পারে। জনগণ আন্দোলন শুরু করলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এই প্রস্তাব তাই উদ্বেগজনকও।
চসিকের দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করা। এ সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রস্তাবটিও অগ্রহণযোগ্য। নতুন করে অ্যাসেসমেন্টে যদি গৃহকর বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকে, তবে সেটা ভয়াবহ ব্যাপার হবে। মহামারীর চলমান সংকট থেকে চট্টগ্রাম নগরীও মুক্ত নয়। জনজীবনে এখনও অর্থনৈতিক সংকট বিরাজমান। বিশাল সংখ্যক মানুষ ভাড়া বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। এমন অবস্থায় বেশিরভাগ বিল্ডিংয়ে বাসা ফাঁকা পড়ে আছে। এখনও যারা শহরে আছে, তাদেরও অনেকের বাড়িভাড়া বাকি আছে। তাই বাড়িওয়ালাদের বাসাভাড়া বাবদ আয় তেমন সুবিধাজনক নয়। মানুষের আয় বন্ধ থাকলে তারা কীভাবে গৃহকর পরিশোধ করবে? এমন সময়ে নগরবাসীর অভিভাবক চসিক মেয়র এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যদি মানবিক আচরণ না করেন, তাহলে নগরবাসী এবং চসিকের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সিটি কর্পোরেশনের প্রতি অনুরোধ, জনগণের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন।

হাসান তারেক
বাড়িভাড়া নয়, বর্গফুটের দিকে নজর দেওয়া উচিত
আমি মনে করি, পৌরকর মূল্যায়নের জন্য বাড়িভাড়া নয়, বাড়ির বর্গফুটের দিকে নজর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ সব বাড়ির ভাড়া একই হয় না। কোনো বাড়ির আয়তন ছোট আবার কোনো বাড়ির বড়। এছাড়া মহামারী জনজীবনকে করেছে দুর্বিষহ। এতে সাধারণ মানুষের সক্ষমতা কমেছে।
যারা মোটমুটি ঘরভাড়ার ওপর নির্ভর করেন তারা আজ অসহায়। কারণ এরই মাঝে অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তাদের অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। এতে বাড়িওয়ালারা হতাশার মাঝে আছেন।
আমার মতে, ২০১৭ সালের পূর্বের পদ্ধতিতে পৌরকর আদায় করা যেতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই চিন্তা থেকে দূরে থাকা উচিত। কেননা মানুষ কষ্টে আছে। সবকিছু স্বাভাবিক হলে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা যেতে পারে।

শাহ নেওয়াজ
নতুন অ্যাসেসমেন্ট করার সময় এখনো আসেনি
স্থগিত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করার সময় এখনো আসেনি। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের পৌরকর আদায় পদ্ধতিও বিতর্কিত। চট্টগ্রাম শহরে নির্মিত সব গৃহমালিকের আর্থিক অবস্থা ও দালানের ধরন এক নয়। ৩০ থেকে ৪০ ভাগ দালান জরাজীর্ণ। কোনো কোনো গৃহের মালিক তাদের গ্রামের জমি বিক্রি করে এবং সারা জীবনের অর্জিত সঞ্চয় দিয়ে ঘর করেছেন। এদের কেউ কেউ আর্থিক টানপোড়নে বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি। এ সমস্ত গৃহমালিককে গৃহকরের আওতামুক্ত রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।
মহামারীর ধাক্কায় বিচলিত গৃহমালিকরা এখন দিশেহারা। ভাড়া দিতে না পেরে ভাড়াটিয়ারা গ্রামমুখী হওয়ায় অনেক বাসা খালি পড়ে আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাসাবাড়িতে ভাড়ায় চালিত অনেক স্কুল, কোচিং সেন্টার ও ব্যাচেলর মেস বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কমিউনিটি সেন্টার। অনেক প্রবাসী চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এছাড়া কাজ না থাকায় বিভিন্ন পেশাজীবী বর্তমানে আর্থিক টানাপোড়নে আছেন; যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে গৃহমালিকদের ওপর। বাসা খালি থাকায় অনেক গৃহমালিক বাসাভাড়া কমিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না। অলিগলিতে এখন বাসাভাড়ার সাইনবোর্ড ঝুলছে। অথচ গৃহ মেরামত ও সংরক্ষণ ব্যয় বেড়েছে বহু গুণ।
জলাবদ্ধতা দূর করতে সিটি কর্পোরেশন নগরীর অলিগলিসহ রাস্তা ও পানি নিষ্কাশন ড্রেন কয়েক ফুট উঁচু করায় নগরীর হাজার হাজার বাড়ি এখন রাস্তা থেকে ৩ থেকে ৫ ফুট নিচুতে। ফলে বর্ষায় এসব দালান হাঁটুজলে ডুবে থাকে। মধ্যম হালিশহর, হালিশহর, আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, বাদুরতলাসহ নগরীর অনেক এলাকায় দালানের নিচতলা এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন, তলিয়ে যাওয়া দালানগুলোর নিচতলা ভরাট করে সংস্কার করার কোনো উপায় নেই। এজন্য সিটি কর্পোরেশনের অপরিকল্পিত রাস্তা ও ড্রেনেজ সংস্কার প্রকল্পই দায়ী। খাল খনন না করে এবং ড্রেনের গভীরতা না বাড়িয়ে শুধুমাত্র রাস্তা ও ড্রেনের উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে। এতে চলাচলের রাস্তা জলাবদ্ধতামুক্ত হলেও বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যায় হাজার হাজার বাড়ির নিচতলা ও টিনশেড বসতঘর।
তাড়াহুড়ো করে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার করায় নগরীবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে। এই জটিল ও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করার উদ্যোগ হবে অমানবিক।

প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়
পৌরকর পুনর্মূল্যায়ন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার কিংবা নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করা করোনাকালীন এই দুঃসময়ে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপানো ছাড়া আর কিছু নয়। সিটি কর্পোরেশনের এমন সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, করোনাকালীন চাকরিজীবীসহ অনেকে কাজ হারিয়েছেন। শহরের অনেক বাড়িতে ভাড়াটিয়া নেই। যেখানে এক সময়ে বাসাভাড়া পাওয়া মুশকিল ছিল সেখানে প্রতিটা বাড়িতে টু-লেট সাইনবোর্ড ঝুলছে। আর্থিক সংকটের কারণে মানুষ শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। যে সমস্ত ভবন মালিক কেবলমাত্র ঘরভাড়ার ওপর নির্ভরশীল তাদের অবস্থা নাজুক। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অবৈধ ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যরা সবাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
করোনায় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ সকলের আয় উপার্জন কমেছে। এরপরও লোকজনকে পৌরকর পরিশোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে পৌরকর সহনীয় পর্যায়ে থাকা উচিত। কিন্তু অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিলে জনগণ সময়মতো পরিশোধ করতে চাইবে না। তারা মামলা, আপত্তি ও বিবাদে জড়াবে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
এছাড়া সাধারণ জনগণ সিটি কর্পোরেশনের ওপর একরকম বিরক্ত। কারণ জনগণ কর্পোরেশনের যতটুকু সেবা পাবার কথা তার পরিবর্তে দিন দিন মশা-মাছির উপদ্রব, রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমায় পচা দুর্গন্ধ, ধুলোবালি, জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট। যানজট, রাস্তাঘাট হকারদের দখল, করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় জনগণের দুঃখ-দুর্দশার শেষ নেই। যেখানে প্রতিদিনের চলমান সমস্যা সমাধানে কর্পোরেশন ব্যর্থ সেখানে পৌরকর বৃদ্ধি করা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর শামিল। সুতরাং বর্তমান সময়ে কর বৃদ্ধি করে জনগণের কষ্ট বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাই মাননীয় মেয়র মহোদয়ের নিকট প্রার্থনা, পূর্বের পৌরকর স্থগিতাদেশ বহাল রেখে চলমান নিয়মে কর গ্রহণ করুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধহেফাজতের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মুনির গ্রেপ্তার