আমি কাউকে কিছু করি নাই। চাল-ডাল দিবে বলে ঢুকাই দিছে। আমি এখন ভালোমতো বাঁচতে চাই। ৩ বছর অন্যের হয়ে সাজাভোগ করার পর জামিন পেয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার ফটক থেকে বের হয়ে আজাদীকে এসব কথা বলেন ছিন্নমূলের বাসিন্দা মিনু।
তিনি বলেন, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের সীতাকুণ্ড অংশের ছিন্নমূলে থাকার সময় প্রতিবেশী মর্জিনার সাথে আমার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে সে কুলসুম নামের এক জনের হয়ে আমার কাছে এসে বলে, এক জায়গায় গেলে তোকে চাল-ডালসহ টাকা পয়সা দেওয়া হবে। তোর নাম হবে কুলসুম। কুলসুম বলে কেউ ডাকলে তুই হাত তুলবি। ১ মাসের বেশি তোকে সেখানে থাকতে হবে না। মিনু আরও বলেন, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ৩টি বছর ফিরিয়ে দেয়া হোক। যাদের কারণে আমি স্বামী সন্তান হারিয়েছি, তাদের বিচার চাই।
কুলুসম আক্তার কুলসুমী নামে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির হয়ে প্রায় ৩ বছর সাজাভোগ করার পর গতকাল বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম কারাগার থেকে ছাড়া পান মিনু। সে সময় তার সাথে ভাই মো. রুবেলও উপস্থিত ছিলেন।
তিনিও বোনের সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার বিচার দাবি করেন। এর আগে সকালে আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের আদালতে মিনুর মুক্তির বন্ড দাখিল করেন। পরবর্তীতে এই আদেশের কপি জেল সুপারের কাছে পাঠানো হয়। তারও আগে গত ৭ জুন উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ মিনুকে মুক্তি দিয়ে নির্দেশ দেন।
একইসঙ্গে প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে গ্রেপ্তারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া মিনুর কারাভোগ করার ঘটনায় তিন আইনজীবী ও এক ক্লার্ককে তলব করা হয়। গত ৩১ মার্চ মিনুর অন্যের হয়ে সাজাভোগ করার ঘটনাটি জনস্বার্থে উচ্চ আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ আজাদীকে বলেন, মিনুর এ পরিণতির পর তার তিন ছেলের ঠাঁই হয় একটি এতিম খানায়। সেখান থেকেই মূলত মিনুর অন্যের হয়ে সাজাভোগ করার বিষয়টি জানতে পারি। একপর্যায়ে তা কারাগার কর্তৃপক্ষকে জানাই। কিন্তু তারা বিশ্বাস করছিল না। পরে আদালতের নির্দেশে কারাগারের একটি বালাম বই দেখে অন্যের হয়ে মিনুর কারাবাস করার ঘটনাটি পরিস্কার হয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে।
এরপর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের আদালতের নজরে দিলে তিনি জেল সুপারের বক্তব্য ও মিনুর বক্তব্য রেকর্ড করেন। একপর্যায়ে গত ২২ মার্চ জেল সুপারের বক্তব্যের রেকর্ডসহ আদালতে সংরক্ষিত কুলসুমীর ছবি সম্বলিত নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। গোলাম মাওলা মুরাদ আরও বলেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় মিনুর এক সন্তানের মৃত্যু হয়। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিষয়টি তাকে জানানো হয়। এর আগে ঘটনার শুরুর দিকে মিনুর স্বামী বাবুল তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে কোতোয়ালী থানাধীন রহমতগঞ্জের একটি বাসায় মোবাইল ফোনে কথা বলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস কর্মী কোহিনূর আক্তারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশ রহমতগঞ্জের একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হলেও পরে সেটি হত্যা মামলায় (মামলা নং ০৯(৭)০৬) রূপ নেয়। পরবর্তীতে কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। আদালত সেই চার্জশিট আমলে নিয়ে কুলসুমীর বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রয়োজনীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শেষ করে তৎকালীন অতিরিক্ত ৪র্থ মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ এবং কুলসুমীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোনা জারি করেন।
আদালতসূত্র জানায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও গ্রেফতারি পরোনা জারির পর কুলসুমী সুকৌশলে তার জায়গায় মিনুকে আদালতে উপস্থাপন করে এবং তার নির্দেশ মতে মিনু আদালতে নিজেকে কুলসুমী বলে দাবি করেন। একপর্যায়ে ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমীর জায়গায় মিনুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
আদালতসূত্র আরও জানায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আদেশের আগে আদালতের পরোয়ানামূলে কুলসুমীকে গ্রেফতার করে ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। টানা প্রায় দুই বছর হাজতবাস করে ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। উল্লেখ্য, কুলকুম আক্তার কুলসুমী লোহাগাড়া উপজেলার আহাম্মদ মিয়ার বাড়ির আনু মিয়ার মেয়ে।