দুর্বিষহ সময় পার করে চলেছি আমরা সবাই। জানিনা সামনে আরো কত কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য! স্বজন পরিবেষ্টিত একান্ত আপন মানুষগুলো বিদায় নিয়ে চলেছে একে একে এ পৃথিবী থেকে। ’মৃত্যু’ ছোট্ট একটা শব্দ, বিশাল এক শূন্যতা। যার যার যুদ্ধ তাকে একাই সামাল দিতে হচ্ছে। মন ছুটে গেলেও কোন উপায় নেই স্বজনদের পাশে যুদ্ধে তাদের শক্তি হয়ে দাঁড়াবার। ছুটে গিয়ে শেষ দেখা দেখে বিদায় জানাবারও কোন উপায় রাখেনি বিধাতা। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সম্পর্কগুলো। পরিবারগুলো ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। যাদের গেছে শুধু তারাই উপলব্ধি করতে পারছে তারা কি হারিয়েছে। একা একা হাসপাতালে যুদ্ধজয় করে যারা ফিরে এসেছে, তারা বোধকরি কোনদিন ভুলবোনা সে ভয়ঙ্কর বীভৎস নিঃসঙ্গ অভিজ্ঞতার কথা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শ্বাসরুদ্ধ যুদ্ধ চলছে ১০-১২ দিন, অনেকের ক্ষেত্রে বড়জোরএকমাস। তারপর সমস্ত উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে নেমে আসে নিগাঢ় নিস্তব্ধতা পরিবারগুলোতে। প্রাণহীন এক জীবন, শুধু ঢিপ্ ঢিপ্ যন্ত্রটা চলছে সবার। চারদিক ঘিরে সবকিছুই আছে, কিন্তু মনে হয় কিছুই নেই -হাসি নেই, আনন্দ নেই, সুখ স্বস্তি কিছুই নেই।
আমরা যখন বেঁচে থাকি তখন পরিবারের কত টেনশন, কত ব্যস্ততা আমাদের ঘিরে, সুস্থতা অসুস্থতা, চিকিৎসা, সেবা, খাওয়া দাওয়া, নিয়মকরে প্রতিদিন কুশলাদি আদান প্রদান ইত্যাদি হাজারও রুটিনমাফিক কর্তব্য উৎকন্ঠা। একটা টেলিফোন এনে দিত দূরে থাকা স্বজনের মনে প্রশান্তি নয়তোবা কপালে চিন্তার রেখা। স্বজন যখন অসুস্থ তখন একটা ফোনের অপেক্ষা, আর ফোনে রিং যেন বুকে সজোরে হাতুড়ির একেকটা আঘাত -এরপর সবকিছু শান্ত, নেই ব্যস্ততা, নেই আকুলতা, নেই উৎকন্ঠা, নেই বাড়তি কোন টেনশন। আছে বুকে চেপে থাকা খুব ভারী এক পাথর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র স্মৃতি, নীরব অশ্রু আর অখণ্ড নীরবতা।
মুখে আমরা যতই বলে চলি ‘ভালো আছি, ভালো থাকার চেষ্টা করছি ইত্যাদি ইত্যাদি।’ কিন্তু বাস্তবে ভালো থাকার কোন কারণই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! লকডাউনের প্রথমদিকটাতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি নিজেকে ভালো রাখার। ব্যস্ত থাকতে চেয়েছি গান, নাচ, কবিতা, গল্প, রান্না, বাগান, লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকালেই এর প্রমাণ মিলে। যত দিন যাচ্ছে হতাশা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে।একদিকে যেমন করোনা ভীতি আমাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে অন্যদিকে ‘সচেতনতা’ আমাদের পায়ে বেড়ি পরিয়েছে। কারো কাছে যেতে মন সায় দেয় না এই ভেবে, নিজের অজান্তেই হয়তো কাউকে আক্রান্ত করে ওর পরিবারের সর্বনাশের কারণ হয়ে পড়বো! ‘সংকোচতা’ মনে বেড়ি পড়িয়েছে এই ভেবে যে, যার কাছে যাবো সে পছন্দ করবে তো !
সবচাইতে করুণ অবস্থা বোধকরি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে থাকা আমাদের সন্তানদের অনিশ্চিত স্থবির জীবন। এদের আগামী জীবনচিত্র ছবি হয়ে চোখে আর স্বপ্ন সাজায় না। আয় রোজগার, অভাব, অপরাধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে! সব মিলিয়ে আমরা সবাই বড্ড কষ্টে আছি। মাঝে মাঝে এই কষ্টের সাথে বাড়তি ভয় এসে ভর করে ।এর কারণ আমাদের দেশের মানুষের অসচেতনতা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভয়াবহ চিত্র দেখার পরও মানুষ কিভাবে এতটা উদাসীন হতে পারে তা কোনভাবে বোধগম্য হয় না। বেঁচে থাকলে উৎসব জীবনে অনেক আসবে,এই সাধারণ কথাটাই কেউ বুঝতে চায় না। টিভিতে সচিত্র প্রতিবেদন দেখে দেখে একটা কথাই মনে হয়, “যা হয় হবে, এবছর উৎসবে সামিল হতেই হবে, সামনের বছর যদি না বাঁচি!”এর মূল্য আমাদের যে কত প্রাণের বিনিময়ে পরিশোধ করতে হবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের বোধহীন জনগণ তা মানবে কেনো! শ্রীলঙ্কার মত দেশ, শতভাগ শিক্ষিত স্বল্প জনগণ, করোনাকালীন শুরু থেকে যেখানে খুব কড়াকড়িভাবে চলেছে কারফিউ, শক্ত লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি। কঠোরভাবে মানা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। এতকিছু মেনেও শেষরক্ষা করতে পারছে না ওরা। ভারতের অবস্থা দেখে আমাদের দেশের জ্ঞানীগুণী সবাই আজ শংকিত ঈদ পরবর্তী করোনা প্রকোপ নিয়ে, কিন্তু নির্লিপ্ত দেশের জনগণের এক বৃহদাংশ।
জীবন কিন্তু থেমে নেই, কাজ করছি, বাজার করছি, রান্না করছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, কর্মহীন হয়ে বিনিদ্র রজনী পার করছি, স্বজনহীন হয়ে শোকাগ্রস্ত দিন পার করছি, আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছি, আক্রান্তকারীর স্বজন হয়ে উৎকন্ঠায় ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করছি। ঘড়ির কাঁটা কিন্তু থেমে নেই, টিক্ টিক্ করে এগিয়ে চলেছে, উল্টে চলেছি ক্যালেন্ডারের পাতা এক এক করে- জানি এবং মনে প্রাণে মেনে নিয়েছি ঈশ্বর’ই একমাত্র মুক্তির পথ দেখাবে। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সে দিনের। হতে পারে তা কাল, হতে পারে পরশু, নয়তো আরো কিছু মাস কিংবা বছর পর। এরই মাঝে ভালো থাকতে হবে আমাদের! অভ্যস্ত হতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায়। আমি সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করবো আমার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সর্বোপরি আমাকে ঘিরে থাকা দেশের আর দশজনের জন্য। আপনারাও সুরক্ষিত থাকুন আপনার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সর্বোপরি আপনাকে ঘিরে থাকা আর দশজনের জন্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার