চট্টগ্রাম পাহাড় সুরক্ষার হাল-হকিকত

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি | মঙ্গলবার , ১৫ জুন, ২০২১ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

বর্ষাকাল এলেই আমরা চট্টগ্রামের পাহাড় নিয়ে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড় নিয়ে আহাজারি করি। উৎকণ্ঠায় মেতে ওঠি। এটি আমাদের সাংবাৎসরিক কর্মকাণ্ডের অংশ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের আমলাদের অপেশাদারত্বের চরমাবস্থা এটি। ২০০৭ সালের ১১ জুনের মর্মান্তিক জীবননাশ ঘটেছিল ১২৭ জনের। মাত্র ৪২৫ মিলিমিটার ধারাবাহিক বৃষ্টির কারণে। আমদের তা প্রায় ভুলে যেতে হয়েছে। বছরের মে জুন মাসে এলে আমরা তৎপর হয়ে উঠি। প্রায় দেড় দশক হতে চলেছে এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ের করুণ ইতিহাসের বয়স। আমলাতন্ত্র আমাদের আবেগ, অনুভূতি, আহাজারি, মানবতাকেও এখন নিয়ন্ত্রণ করে। পাহাড় বিপর্যয়ের ১১ জুন পৃথিবীর যেকোন মর্মান্তিক ঘটনার চেয়ে কম বিষাদগ্রস্ত নয়। আমলার মামলা অথবা রাজনীতির জন অসম্পৃক্ততায় এখনো তা যথার্থ আমল পায়নি।
তখনকার গৃহীত ৩৬ দফা পাহাড় সুরক্ষার সুপারিশমালা আলোর মুখ দেখেনি। এরপরে রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চলসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক প্রাণ। এতে তথাকথিত দায়িত্বশীলদের মনোপীড়া কিংবা দেশাত্ববোধের জাগরণ ঘটেনি। সরকারের আমলা নির্ভরতা এবং নির্লিপ্ততাও এর জন্য কম দায়ী নয়। সরকারের আবেগ-অনুভূতিও আমলানির্ভর।
দীর্ঘ এ সময়ে আমলা এসেছে আমলা গেছে। কর্ণফুলীর পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আহাজারি নিয়ে, দুঃখ ও বেদনা নিয়ে। চট্টগ্রামের মানুষের আহাজারি হয়তো স্বর্গেও পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জানা যায়, এ পর্যন্ত পাহাড় সুরক্ষার মাথাভারী কমিটির ২১ টি সভা হয়েছে।
মে জুন মাস আসলেই আমলাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। আমরা গত ১৫ বছর তা-ই দেখেছি। বিশেষ করে মেঘের গর্জন শুনলে, ধারাবাহিক বৃষ্টি দেখলে আমলারা মিথ্যা আহাজারি শুরু করে, জেগে উঠে।
একটি নদীর মাছ সুরক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ আমলারা যতটুকু মিডিয়া কাভারেজ নেয়, ততটুকু তারা দেখাতে ব্যর্থ হয়, পাহাড়ে যখন মানুষের মৃত্যু ঘটে। পাহাড়ের পাদদেশে, খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে বাস করা মানুষগুলোর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নীর্লিপ্ত থাকে তারা বছরের দশ মাস। দেশপ্রেম, মানবতা, চাকরির বিধিমালার প্রতিশ্রুতি এবং ব্যক্তি জাগরণ এক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে। নদী আদালতে গেলেও, পাহাড় এখনো আদালতে যায়নি সেরকম ভাবে।
পাহাড়কে নিয়ে সকল প্রকার খেলা ভূমিদস্যুরা খেলেছে, খেলে চলেছে। প্রশাসন নিরলিপ্ত, নীরব, অন্যমনস্ক থেকেছে অতীতের দীর্ঘ এ সময়ে। নির্লিপ্ত থেকেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেশপ্রেমহীন তথাকথিত কর্মকর্তারা। লোকবলের সীমিত পরিসরের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানটি জেগে জেগে ঘুমিয়েছে। অন্যভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উষ্ণ রক্তের সচল প্রবাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলোকে সাথে নিয়ে যখন এগিয়ে যায়, মানুষের সামনে বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্নকে তুলে ধরে, স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্নের সীমানা ঠিক করে দেয় এবং দেশদুনিয়া থেকে প্রশংসিত হয়। বাঙালির আত্মসম্মান বোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, তখনই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র, ভূমিদস্যু, অপরাজনীতির উত্তরাধিকার তাদের নির্লিপ্ততায় ইতিহাস সৃষ্টি করে, ইতিহাস গড়ে যায় বিড়ম্বনার, স্বপ্নহীনতার, বিপর্যয়ের।একই কথা বছরের দুই মাস চট্টগ্রামের বস্তিবাসীদের, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে থেকে যাওয়া, জীবনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা, জলবায়ু উদ্বাস্তু অথবা ভূমিহীনদের শুনে যেতে হয়-
‘আপনারা পাহাড় থেকে নেমে আসুন। আপনাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা আছে। তাঁবু বাসের ব্যবস্থা আছে।’ ইত্যাদি।
পাহাড়ের খাঁজে বাস করা অসহায় মানুষগুলো এসব কথাকে প্রতারণার সাথে তুলনা করে। সারা বছর এরা বিদ্যুৎ পায়, পানি পায়, অন্যান্য নাগরিক সুবিধার কিছু কিছু পায়। কেমনে পায়? পায়না শুধু স্থায়ী বসবাসের, সদিচ্ছার নিশ্চয়তার কথা।
যারা এই পাহাড়গুলোতে বানভাসি, জলবায়ু উদ্বাস্তু, বস্তিবাসী অসহায় মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনের ব্যবস্থা করে, তারা ঘটনার আড়ালে আবডালে নীরবে-নিভৃতেই থেকে যায় বছরের পর বছর। ব্যবসা করে, অর্থ উপার্জন করে, অসহায় মানুষদের আবাসনকে পুঁজি করে। আমলাতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি, অপরাজনীতির প্রতিশ্রুতি ততদূর পর্যন্ত পৌঁছায় না। পাহাড় ক্রমান্বয়ে আত্মাহুতি দিয়ে আসছে ভূমিদস্যুদের কাছে, সারা বছর এ জন্যেই। আমাদের নির্লিপ্ততায়, উদাসীনতায়।
আমলাতন্ত্র বলে এখন চট্টগ্রামের শহর ও শহরতলীর ১৭ টি পাহাড়ে বাস্তুহীনদের আবাসন আছে। বাস্তবতা এর চেয়েও বেশি থাকলেও সেই মানুষগুলোকে আবাসন প্রতিরক্ষা, সুরক্ষার আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি। বাজেটেও না ।
প্রতিবছর অসহায় সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষ উদ্বেগ নিয়ে চেয়ে থাকে- কখন দুইজন, পাঁচজন কিংবা আরো বেশি মৃত্যুর খবর হয়ে আসবে। পাহাড় বিপর্যয়ের মৃত্যু। আমরা যখন টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্ন দেখাচ্ছি এবং দেশের মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্তির জন্য নিবিড় ভাবে কাজ করতে দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, তখনও আমলাতন্ত্রের দেশপ্রেম নিয়ে আমাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। তাদের নির্লিপ্ততা জনমানুষকে পীড়া দেয়, কষ্ট দেয়। এ কষ্টের শেষ কোথায়।
মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, ‘ফেরাউনের আমলেও আমলাতন্ত্রের চরিত্র এরকমই ছিল।’ তাহলে এই দেশপ্রেমিক যন্ত্রতন্ত্রের আগ্রাসন কিংবা এদের হাত থেকে জনগণের মুক্তি কবে হবে? জনগণ এর পরিবর্তন চায়। দেশে যখন হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, সেরকম একটি স্বপ্ন দেখা, বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর দেশে পাহাড়ের জন্য, পাহাড়ের বিপর্যয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে কতদিন, কেন?
এদের পরিচ্ছন্ন দেশপ্রেমের আবহে পরিবর্তিত হতে হবে। পাহাড় সৃষ্টি করা যায় না। ধ্বংস করা যায়। পাহাড়ের মাটি, বালি চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতাকে, জলাতঙ্ককে, জলমগ্নতাকে উস্কে দিয়ে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। সমন্বয়হীন প্রকল্প, অদূরদর্শী এবং অবৈজ্ঞানিক প্রকল্পগুলোর মাধ্যম দিয়ে শহরের শিরা-উপশিরা খাল-নালাগুলোকে বদ্ধ-আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাহাড় ও খাল-নালার মাটি এবং আবর্জনা দিয়ে কর্ণফুলীর নাব্যতাকে ভবিষ্যতের জন্য নষ্ট করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলতে পারে না।
আমাদের একটি মুক্তিযুদ্ধ ছিল। সে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল। বিসর্জন ছিল। চেতনা ছিল। সেই মুক্তিযুদ্ধের আবহের মুজিব শতবর্ষ আমরা উদযাপন করছি। সমসাময়িক পৃথিবীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
সেরকম একটি দেশের নান্দনিক পাহাড় যখন বিলীন হয়, অর্থকরী নদী যখন নাব্যতা হারাতে বসে, প্রাচ্যের রাণীনগরে যখন জলাবদ্ধতা এবং জলাতঙ্কের কৃত্তিম সন্ত্রাসে, উৎকণ্ঠায় বিদিশাগ্রস্ত থাকে নগরবাসী, তখন দায়ী ব্যক্তিদের, তাদের অদূরদর্শী পরিকল্পনাগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পর্যালোচনা করা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দাবি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শী, জমিদার প্রকৌশলীরা যখন ছয় কিলোমিটার রাস্তা করতে গিয়ে ১৮টি পাহাড় কেটে, পাহাড়ের মাটি নিয়ে ব্যবসা করে, পাহাড়ের সবুজ বাস্তুতান্ত্রিকতাকে নিঃশেষ করে, পরিকল্পনা -অপরিকল্পনা মিশেলে প্রকল্প প্রকল্প খেলা করে এবং নির্লিপ্তভাবে আবেগ উদ্বেগহীন ভাবে কথা বলে,
তখন আমরা ভুলে যাই তারা আসলে মানুষ কিনা। তাদের এ জমিদারি কর্ম কৃত্যের উৎস কি। দেশটাকে যখন উত্তরাধিকারের সম্পত্তি মনে করা হয়। দেশের পরিকল্পনা নিয়ে যখন জমিদারি প্রক্রিয়ার প্রকল্প খেলা বসানো হয়। তখন সাধারণ মানুষ উৎকন্ঠিত, উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। ৯০ ডিগ্রি কোণে খাড়াভাবে পাহাড় কেটে, জরিমানার বেসাতিকে জনসমক্ষে তুলে ধরে যখন প্রধান প্রকৌশলীরা নবাব, বাদশাদের মত কথা বলে, তখন তাদেরকে নিয়ে কথা বলতে আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলি। তখন তাদেরকে আর বিবেক সম্পন্ন মানুষ ভাবার কোনো সুযোগ থাকে না। তবুও সব কিছু নীরব থেকে যায়। নিরলিপ্ত পরিবেশ অধিদপ্তর সীমিত জনবল নিয়ে, অসৎ গোষ্ঠীকে নিয়ে দেহের চুলকানির মত করে পাঁচবার এগিয়ে দশ বার পিছিয়ে যায়। জরিমানা ও মামলার অপেক্ষায় থাকে। তাদের একাজকে জনগণ আই ওয়াশ ছাড়া আর অন্য কিছুই ভাবতে পারে না।
মুক্তিযোদ্ধা হয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের উষ্ণ প্রবাহ নিয়ে, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা নিরলিপ্ত হয়ে এসব দেখে দেখে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারিনা। আমাদের কষ্ট হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আপনি পরিবেশ কন্যা। বঙ্গবন্ধু কন্যা।বঙ্গবন্ধুর অদম্য বিপ্লবী রক্তের উত্তরাধিকার। আপনি অদম্য অগ্রযাত্রার দুনিয়া কাঁপানো নেত্রী। আপনি চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ নিন। চেষ্টা করুন। পাহাড় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আপনি ঘুরে দাঁড়ান এবং এই ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত করুন। নিরলিপ্ত আমলাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন। উত্তরাধিকারের রাজনীতিক সদস্যদের জবাবদিহিতায় আনুন। পাহাড়ের যারা মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাদের অপরাজনৈতিক উত্তরাধিকারদের এবং অপেশাদার আমলাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিন। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বোধ ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখুন। আগামী প্রজন্মের তারুণ্যের স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখুন। এটা আমাদের প্রত্যাশা।
গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ২০০৭ সালের ১১ জুনের মর্মান্তিক পাহাড় বিপর্যয়ের বিপর্যস্ত আত্মাগুলোকে । শ্রদ্ধায় স্মরণ করি, এযাবতকালের পাহাড় বিপর্যয়ে যারা প্রাণ দিয়েছে। তাদের আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়ক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাকালীন শিক্ষার্থীদের অর্জন : হত্যা ও পাশবিকতার কবলে সোনার দেশ
পরবর্তী নিবন্ধনিউ ইয়র্কে সড়কে প্রাণ গেল সন্দ্বীপ প্রবাসীর