সংস্কার পরবর্তী আমূল পরিবর্তন আসছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগের স্থলে নাম রাখা হচ্ছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার। শুধু নাম নয়, পাল্টে যাচ্ছে সেবার ধরনও। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আদলেই এখানে চিকিৎসা সেবা পাবেন রোগীরা। এর মধ্যে সংস্কার কাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী মাসের (জুলাই) মাঝামাঝি সময়ে এই ওয়ান স্টপ ইমাজেন্সি কেয়ারে সেবা চালুর কথা জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর।
হাসপাতাল প্রশাসন বলছে- ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে জরুরি রোগ নির্ণয়ে এক্স-রে যুক্ত করা হবে। স্থাপন করা হবে দুটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) এবং ৬টি হাই ডিপেন্ডেড ইউনিট (এইচডিও)। পর্যায়ক্রমে ৪টি আইসিইউ শয্যা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। আর চিকিৎসকদের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে অন্তত ৫টি কক্ষ। যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবায় মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক, নাক-কান-গলা এবং অ্যানেসথেসিয়াসহ প্রয়োজনীয় সব বিভাগের একজন করে কনসালটেন্ট সার্বক্ষণিক (শিফট ভিত্তিতে) নিয়োজিত থাকবেন। ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে রোগীদের জন্য একশটি শয্যা রাখা হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর আজাদীকে বলেন, একজন রোগী আসা মাত্রই এখানে রাখা হবে। চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করবেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হলে সেটাও এখানে করা হবে।
রোগীদের ২৪ ঘণ্টার মতো এখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এর মধ্যে যেসব রোগীর আর চিকিৎসা প্রয়োজন হবে না বা বাসায় চিকিৎসা নিতে পারবেন, তাদের বিদায় করে দেয়া হবে। যেসব রোগীর আরো দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, শুধু সেসব রোগীকেই আন্তঃবিভাগে ভর্তি দেয়া হবে। মোটকথা, একজন রোগী জরুরি বিভাগে আসার পর জরুরি সব ধরণের চিকিৎসা যাতে এখানেই (ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে) পান, সে আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর। এর আগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংস্কারে একগুচ্ছ পরিকল্পনা তৈরি করে তা প্রস্তাবনা আকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনার কথা বলা হয় প্রস্তাবনায়। আর এই সংস্কার কাজ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগটিকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনতে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। পৃথক তিনটি পেইজে এ সংস্কার কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১। এর মধ্যে একটি পেইজে ২ কোটি টাকা এবং অপর দুটি পেইজে ২ কোটি টাকা (প্রতিটিতে ১ কোটি) বরাদ্দ দেয়া হয়। মূলত এর পরপরই জরুরি বিভাগের সংস্কার কাজ শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, একটি হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধরা হয় জরুরি (ইমার্জেন্সি) বিভাগকে। সংকটাপন্ন রোগীকে জরুরি চিকিৎসার আশায় প্রথমে নিয়ে আসা হয় এই জরুরি বিভাগেই। কিন্তু জরুরি চিকিৎসার কোনো সরঞ্জামই নেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে! শুধু সরঞ্জামই নয়; বিভাগটিতে নেই একজন কনসালটেন্টও! প্রতি শিফটে মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার পদের চিকিৎসক দিয়েই চলে জরুরি বিভাগের এ সেবা। ১৯৬০ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবেই চলে আসছে। যদিও মাঝে-মাঝে এক শিফটে দুজন মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করেন বলে দাবি জরুরি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট ‘জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জামই নেই জরুরি বিভাগে’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জরুরি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়- জরুরি বিভাগে একজন রোগী আসার পর যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে রোগীটিকে পাঠানোর কাজটি করে থাকেন তাঁরা। এছাড়া গুরুতর নয়, এমন রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। আর দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাথমিক ভাবে ড্রেসিং সেবা দেয়া হয়ে থাকে। বছরের পর বছর ধরে মূলত এরকম দায়িত্বই পালন করে আসছেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা। অথচ একজন সংকটাপন্ন রোগীর জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদানের যাবতীয় আয়োজন জরুরি বিভাগে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন- জরুরি বিভাগে কনসালটেন্ট (বিশেষজ্ঞ) থাকাটাও অপরিহার্য। অন্তত কার্ডিওলজি, সার্জারি (অর্থোপেডিক), মেডিসিন ও অ্যানেসথেশিয়ার একজন করে কনসালটেন্ট থাকাটা জরুরি। এছাড়া অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও ড্রেসিং রুমের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের জরুরি কিছু সরঞ্জাম (এঙ-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, ইকো কার্ডিয়াগ্রাম) থাকা প্রয়োজন। এর বাইরে সংকটাপন্ন রোগীর জন্য আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) অথবা এইচডিও (হাই ডিপেন্ডেড ইউনিট) থাকলে সেটিকে একটি আদর্শ জরুরি বিভাগ হিসেবে দেখা হয়।
কিন্তু চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এর কিছুই নেই। কেবল একটি ড্রেসিং রুম রয়েছে, তাও ছোট-খাটো। এর বাইরে শিফট ভিত্তিক একজন করে মেডিকেল অফিসার এখানে দায়িত্ব পালন করেন। অপারেশন থিয়েটার, কিংবা এঙ-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, আইসিইউ বা এইচডিও কোন কিছুই নেই। জরুরি বিভাগের এই দৈন্যদশার বিষয়টি স্বীকার করে সব সরকারি হাসপাতালের চিত্র একই বলে দাবি করেছিলেন চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন। হাসপাতাল পরিচালক ওই সময় বলেন- শুধু এখানেই (চমেক হাসপাতালে) নয়। দেশের সব সরকারি হাসপাতালেই এই ভঙ্গুর চিত্র। তবে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানে জরুরি বিভাগ বলতে গেলে স্বয়ং সম্পূর্ণ। চারজন কনসালটেন্ট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। অপারেশন থিয়েটারের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও রয়েছে। আইসিইউ সুবিধাও বিদ্যমান। সংকটাপন্ন কোনো রোগী আসলে তাঁর জরুরি চিকিৎসা সেবাটা জরুরি বিভাগেই দেয়ার সুযোগ থাকে। জরুরি চিকিৎসা শেষে শারীরিক কিছুটা উন্নতি হলে ওই রোগীকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটাই হওয়া উচিত। বিদেশের হাসপাতালগুলোতেও এই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়ে থাকে বলেও জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন।
২০১৮ সালের ১১ আগস্ট দৈনিক আজাদীর ওই প্রতিবেদন (‘জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জামই নেই জরুরি বিভাগে’ শিরোনামে) প্রকাশের পরই জরুরি বিভাগটি সংস্কারে পরিকল্পনা গ্রহণ করে চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনা, সার্বক্ষণিক কনসালটেন্ট রাখা, এইচডিও, ওটি, এঙ-রেসহ জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম রাখার কথা বলা হয় পরিকল্পনায়। একগুচ্ছ পরিকল্পনা সম্বলিত প্রস্তাবনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ ‘পাল্টে যাচ্ছে জরুরি বিভাগ/একগুচ্ছ পরিকল্পনা’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটি তৈরিকালীন চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস বলতে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সংকটাপন্ন একজন রোগীর জরুরি চিকিৎসা সেবার আয়োজন রাখা হবে এখানে। অর্থাৎ একজন সংকটাপন্ন রোগীর রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা জরুরি বিভাগেই দেয়া সম্ভব হবে। আর মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, অ্যানেসথেসিয়াসহ প্রয়োজনীয় সব বিভাগের একজন করে কনসালটেন্ট সার্বক্ষনিক জরুরি বিভাগে দায়িত্বে থাকবেন।
হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য মতে- হাসপাতালের নিচ তলায় জরুরি বিভাগের পাশে ক্যাজুয়াল্টি, চর্ম ও যৌন রোগ এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন ওয়ার্ড রয়েছে। এই নিচতলা জুড়েই সংস্কার কাজ চালানো হচ্ছে। সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগের সাথে কেবল ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডই রাখার পরিকল্পনা হাসপাতাল প্রশাসনের। বাকি বিভাগগুলো (ফিজিক্যাল মেডিসিন এবং চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগ) হাসপাতালের নতুন ভবনের ৯ ও ১০ তলায় স্থানান্তর করার কথা বলা হয়। হাসপাতালের নিচতলার (ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে বাম পাশের পুরো অংশ) পুরোটা জুড়েই এই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল হাসপাতাল প্রশাসনের। তবে এর একটি অংশে বর্তমানে করোনা ইউনিট স্থাপন করে সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
সংস্কার কাজের প্রায় ৭০ শতাংশ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, আশা করছি জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে। সেটি হলে আমরা জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়েই এই ওয়ান স্টপ ইমর্জেন্সি কেয়ার চালু করতে পারবো।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- বিভাগটিতে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের (ইএমও) ৭টি পদ আছে। বর্তমানে ৭ জন ইএমও এখানে কর্মরত আছেন। দিনে তিনটি শিফটে এখানে দায়িত্ব পালন করে থাকেন চিকিৎসকরা। প্রতি শিফটে বেশির ভাগ সময়ই একজন ইএমও দায়িত্বে থাকেন। তবে মাঝে-মাঝে এক শিফটে দুজনও দায়িত্বে পালন করেন বলে দাবি হাসপাতাল প্রশাসনের। হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য মতে- জরুরি বিভাগের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। আর দৈনিক প্রায় ২০০ রোগী জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে তাঁরা বাসায় ফিরে যান।