প্রথম আলোর শেষের পাতায় একটা খবরে চোখ আটকে গেলো। যে-সময়টা আমরা পার করছি তা একটা অস্বাভাবিক সময়। খবরের কাগজের প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত খবরগুলো কোন স্বপ্নের হদিস দেয় না কেবল হতাশা ছাড়া। সেখানে এই ব্যতিক্রমী খবরটা যেন আলোর ঝলকানির মতো। তপ্ত রোদে এক পশলা বৃষ্টির মতো। বিশ্বের অন্যতম কুলিন চলচ্চিত্র উৎসবে আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা বিভাগে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহেনা মরিয়ম নূর’ ছবি আঁ সার্তে রিগা বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে। ৩ জুন উৎসব কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে মনোনয়ন পাওয়া ছবিগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। আঁ সার্তে রিগা বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে ১৫টি দেশের ১৮টি সিনেমা। প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ পরিচালকদের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিতে ১৯৭৮ সালে বিভাগটি চালু করেন জিল জ্যাকব। এই বিভাগে বিজয়ী সেরা ছবিকে দেওয়া হয় ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) ইউরো। আমি আনন্দিত হওয়ার কারণ বাংলাদেশ সম্মানিত হওয়ার কারণে। সেটা যে-কোন প্রান্ত থেকে আসুক। বাংলাদেশের জন্য এটা বিরল এবং নতুন। তাই যে কোন ইতিবাচক খবর আমাদের আশান্বিত করে, আনন্দিত করে। সিনেমা কখন দেখেছি ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলো আদৌ আছে কিনা জানি না। একটা সময় ছিল প্রচুর সিনেমা দেখতাম হলে বসে, বন্ধুদের সাথে, পরিবারের সদস্যদের সাথে, এমন কি মায়ের চশমার বঙ থেকে টাকাও চুরি করেছি সিনেমা দেখার জন্য। ক্রমশ কেমন করে জানি সিনেমা যাপনের সেইসব দিনগুলো একেবারেই হারিয়ে গেল। ’৯০ এর দশক থেকে সিনেমা আর দেখার সুযোগ রইল না। ভালো নির্মাতারা দূরে সরে গেলেন। সামাজিক বিনোদনের ছবিগুলোর স্থান দখল করে নিলো অশ্লীল ছবি। তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি মুখ ফিরিয়ে নিল। তাতেই ধস্ নামলো সিনেমার। কারণ মধ্যবিত্তরাই মূলত সামাজিক-সাংস্কৃতিক দোলাচলের অংশ। তারাই টিকিয়ে রাখে সংস্কৃতিকে। আমাদের সন্তানেরা জানে না এরকম একটা বিনোদনের ব্যাপার ছিল। মৃত প্রায় এই চলচ্চিত্র শিল্পকে হঠাৎ হঠাৎ কেউ এসে যে চমকে দেননি তা নয়। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত দর্শকদের সিনেমামুখী করেছিলেন। তাঁর ছবিগুলো দর্শক গ্রহণ করেছিল তাঁর নাটকের মতোই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা হুমায়ূন আহমেদকে খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলি। কবরী-ববিতা, শাবানা-রাজ্জাক, আলমগীর, বুলবুল আহমেদ এদের ছবি আমরা হলে গিয়ে দেখেছি। মিষ্টি পারিবারিক একটা আবহ ছিল। এদের পরবর্তী মৌসুমী, পূর্ণিমা বা আরো যারা আছেন তাদেরকে আমরা টিভিতেই দেখেছি হলে গিয়ে তাদের সিনেমা দেখার সুযোগ হয় নি। এরপরের অবস্থা আর জানা নেই। মাঝেমধ্যে দেখা যায় আমাদের দেশের অভিনেতা অভিনেত্রীদের ভারতে গিয়ে দাপটের সাথে অভিনয় করতে। প্রযুক্তির ব্যবহারে দুনিয়াটা এখন হাতের মুঠোয়। তাছাড়া মুক্ত আকাশ দর্শকদের রুচিও বদলে দিয়েছে। আমরা আমাদের সিনেমার ইতিহাসকে সুস্থ বিনোদন হিসেবে দাবি করতে পারি। আন্তর্জাতিক বিচারের মান দাবি করতে পারি না। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা আমাদের রাজনীতির মতোই পিছিয়ে পড়েছি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে নির্মাতা মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকী বলেন, ‘অনেক সম্ভাবনা নিয়ে অসম্ভবের মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সিনেমা। আমাদের আছে একটা বিশাল এবং বিচিত্র দর্শক শ্রেণি যারা নানা রকম সিনেমা দেখতে প্রস্তুত। দারুণ প্রতিভাবান তরুণ নির্মাতাও আছে। অথচ আমরা এখনো অসম সেন্সরের মুখোমুখি! যুগটা নেটফ্লিঙের অথচ আমাদের কড়া সেন্সর। বড় শহরগুলোতে এখনো মাল্টিপ্লেঙ নিয়ে যেতে পারিনি। এ-দুটোর সমাধান হলে সিনেমাকে আর কারো কাছে হাত পাততে হবে না”। এটা আমার কথা যে বাংলাদেশের নির্মাতাদের কেউ কেউ এখানে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে প্রদর্শনীর জন্য জায়গা করে নিতে শুরু করেছেন। ২০০২ সালে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম শোনা গিয়েছিল বাংলাদেশের নাম। সেবার ডিরেক্টরস ফোর্ট নাইট বিভাগে নির্বাচিত হয় তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। ১৯ বছর পর এবার আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নিল বাংলাদেশ। আঁ সার্তে রিগা (un certain regard) উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটির নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ অত্যন্ত বিনয়ী ও নিভৃতচারী তরুণ। তাকে নিয়ে মাতামাতি করাটা তাঁর পছন্দ নয়। এমন কি এত বড় অর্জনের পরও তাকে কোন টক শো কিংবা পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নেই! নিজের ঢাক নিজেই বাজানোর যুগে তিনি তাঁর প্রাপ্য ঢাকটা কাউকে বাজাতেই দিচ্ছেন না। বরং এসবে নাকি তিনি বিব্রতবোধ করেন। তবে প্রথম আলোতে একটা বিবৃতি তিনি দিয়েছেন, ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে অফিসিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের প্রথম ছবি হিসেবে ‘রেহেনা মরিয়ম নূর’ ছবিটা আমন্ত্রিত হওয়ায় আমি আনন্দিত ও সম্মানিত। এই অর্জন পুরোপুরি আমার টিমের। তাঁরা সবাই মিলে অমানষিক কষ্ট করেছেন আর সর্বোচ্চ উদ্যমটা দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ এই টিমের কাছে।” নিজের সিনেমার গল্প প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক ভাইবোনের মধ্যে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার চিন্তা ভাবনায় তাদের অনেক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে আমার বড় তিন বোনের। রেহেনাকে নিয়ে লিখতে শুরু করি সম্ভবত সেরকম একটা জায়গা থেকেই। তার ক্ষোভ, তার অবিশ্বাস নিয়ে ভাবি তার ভেতরের কমপ্লেকসিটি ও কনট্রাডিকটারি আচরণ বুঝার চেষ্টা করি। তার আচরণই আমাকে উৎসাহিত করে। ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রেহেনা মরিয়ম নূরকে কেন্দ্র করে। সেখানে রেহানা একজন মা, মেয়ে, বোন ও শিক্ষক। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ তার জীবন। এক সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বের হয়ে তিনি এমন এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন যা তাঁকে প্রতিবাদী করে তোলে। এক ছাত্রীর পক্ষ নিয়ে সহকর্মী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য হন। একই সময়ে তাঁর ছয় বছরের মেয়ের বিরুদ্ধে স্কুল থেকে রূঢ় আচরণের অভিযোগ আনা হয়। এমন অবস্থায় রেহেনা তথাকথিত নিয়মের বাইরে এসে সন্তানের জন্য ন্যায় বিচার খুঁজতে থাকেন। অভিনন্দন এই তরুণ নির্মাতাকে। তিনি আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটায় আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় আসুক আন্তর্জাতিক উৎসবে জায়গা করে নিক। এটাই প্রত্যাশা করি।