কোন প্রক্রিয়ায় শিশু পার্ক ইজারা

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১০ জুন, ২০২১ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

নগরের কাজীর দেউড়িস্থ সার্কিট হাউস সংলগ্ন শিশু পার্কের ইজারা প্রক্রিয়া নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কোন প্রক্রিয়ায় শিশুপার্কটি ইজারা দেয়া হয়েছে তা জানাতে বলেছে মন্ত্রণালয়। এর আগে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চসিক কর্তৃক পার্কটি ‘আইনবহির্ভূতভাবে’ ইজারা দেয়া হয়েছে দাবি করে তা বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও সচিবের কাছে পৃথক দুটি আধা সরকারি পত্র (ডি.ও) দিয়েছিলেন। জানা গেছে, ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের জন্য ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস লি.’ নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানকে শিশু পার্কটি ইজারা দেয় চসিক। এর আগে ১৯৯২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ বছরের জন্যও একই প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এই ইজারা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। অর্থাৎ মেয়াদ শেষে ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’র সঙ্গে ইজারা চুক্তি নবায়ন করে চসিক। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ফলে নবায়নকৃত চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া চুক্তি নবায়নের আগে সরকারের অনুমোদনও নেয়া হয়নি। যা স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের লঙ্ঘন।
আইনবহির্ভূত ইজারা : গত ৯ মে শিশু পার্কটির ইজারা বাতিলের অনুরোধ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দিন আহমদকে পৃথক দুটি আধা সরকারি পত্র দেন বলে দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও চট্টগ্রাম-৯ আসনের সাংসদ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পত্রে তিনি বলেন, ‘ইজারা চুক্তি সরকারের পূর্বানুমোদনক্রম ব্যতিরেকে করা হয়, যা সিটি কর্পোরেশন আইন-২০০৯ এর সুস্পষ্ট ব্যত্যয়।’ নওফেল বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন আইন ২০০৯ এর ৮০ (২)(গ) ধারায় বলা হয়েছে, কর্পোরেশন সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে দান, বিক্রয়, বন্ধক, ইজারা বা বিনিময়ের মাধ্যমে অন্য কোন পন্থায় যে কোনো সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর করতে পারবে। তাই পার্ক ইজারায় সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে প্রতীয়মান হয়। উল্লিখিত আইনবহির্ভূতভাবে পার্কটি হস্তান্তরের ফলে দর্শনার্থীদের বেড়ানোর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে যা মোটেই কাম্য নয়। শিক্ষা উপমন্ত্রী আধা সরকারি পত্রে উল্লেখ করেন, শিশু পার্কটিতে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবক বেড়াতে আসেন এবং যা নগরবাসীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র।
অত:পর মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা তলব : গত ৭ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চসিকের কাছে ইজারার ব্যাখ্যা চেয়ে পত্র পাঠানো হয়। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো এ পত্রে বলা হয়, ‘সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক কোন প্রক্রিয়ায় ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস লিমিটেড’কে শিশু পার্কটি ইজারা প্রদান করা হয়েছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা/মতামত প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল’। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কনফিডেনশিয়াল বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে?’
জানতে চাইলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের চিঠির বিষয়টি আমার নলেজে নেই। তবে শিক্ষা উপমন্ত্রী একটি ডি.ও দিয়েছিলেন। মেয়র বলেন, পার্কটি নিয়ে কী করা যায় তা আমরাও চিন্তা করছি। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যে লিজ দেয়া হয়েছে তার বৈধতা কতদূর সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব। মন্ত্রণালয় যেভাবে চেয়েছে সেভাবে হবে।
চুক্তিতে কি আছে : ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস লি. এর সঙ্গে চসিকের সম্পাদিত চুক্তিতে ১৭টি শর্ত আছে। এতে বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ শেষে অর্থাৎ ইজারার মেয়াদ ১৫ বছর শেষ হলে চুক্তি নবায়নের সুযোগ রাখা হয়। চুক্তি অনুায়ায়ী সিটি কর্পোরেশন প্রতি মাসে রাজস্ব পাবে দেড় লাখ টাকা। তবে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ১৫ শতাংশ হারে রাজস্ব বাড়বে। পূর্বে চসিক প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা রাজস্ব পেত। এছাড়া চুক্তি নবায়ন করে এককালীন কোনো টাকা পায়নি চসিক। পূর্বে পার্কে প্রতি দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি একটি রাইডসহ ছিল ৫০ টাকা। যা চুক্তির পর ৬০ টাকা হয়েছে।
ইজারাদারের বক্তব্য : শিশু পার্কটির জেনারেল ম্যানেজার নাসির উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমাদের প্রথম যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে নবায়ন করার শর্ত ছিল। সে আলোকে নবায়ন করেছি। দ্বিতীয়বার সিটি কর্পোরেশন আমাদের পার্কটি আধুনিয়কায়ন করা ও নতুন নতুন রাইড স্থপানসহ অনেকগুলো কঠিন শর্ত দিয়েছে। সে আলোকে আমরা পর্কের আধুনিকায়নও করেছি। তিনি বলেন, পার্কটির মূল ভূমি মালিক বাংলাদেশ সেনাবহিনী। শুধুমাত্র শিশু পার্ক করার শর্তে জায়গাটি সিটি কর্পোরেশনকে তারা দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন অন্য কিছু করতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অনুমোদন না দিলে সিটি কর্পোরেশনের আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেছে।
দাবি আছে পার্কটি উচ্ছেদের : ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শিশু পার্কটিকে ‘জঞ্জাল’ আখ্যায়িত করে অপসারণের দাবিতে পার্কের সামনে ‘নাগরিক উদ্যোগ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছিল। সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। দায়িত্বপালনকালেও তিনি পার্কটি উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিলেন এবং বিকল্প স্থানে পার্ক করতে পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকায় দুটি পরিত্যক্ত জায়গা বাছাই করেছিলেন। এর আগে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিও ‘নাগরিক উদ্যোগ’র ব্যানারে উচ্ছেদের দাবিতে পার্কের সামনে মানববন্ধন হয়েছিল। সেখানে অংশ নিয়ে খোরশেদ আলম সুজন পার্কটি সরিয়ে নিতে তৎকালীন সিটি মেয়রকে অনুরোধ করেছিলেন। অবশ্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জায়গায় স্থাপিত শিশু পার্কটি উচ্ছেদে দাবি ছিল সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদপ্তরের। মাঝখানে ২০১৪ সালে একবার উদ্যোগ নেয়া হয় উচ্ছেদের। তবে ওই সময় পার্কের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ বহাল থাকায় উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সার্কিট হাউস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সভায় তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে পার্কটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই সময় বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত) নিজেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন পার্কটি উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকও করেন ওইসময়। পরবর্তীতে একই বছরের এপ্রিল মাসে জেলা প্রশাসনের একটি প্রতিনিধি দল বিষয়টির অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে চসিকের স্টেট বিভাগের সাথে কয়েক দফা বৈঠকও করেছিলেন।
এর আগে ২০০৯ সালের ৬ মে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৃতীয় সভায় শিশু পার্কটি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ১৪ অক্টোবর চসিকের পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে পত্র দিয়ে শিশু পার্ক তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ১৩ জুলাই তিন একর জায়গার উপর শিশুপার্ক স্থাপনে চসিককে অনাপত্তি দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ২০০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন এক্সিকিউটিভ অফিসার মোহাম্মদ নুরুল আবছার স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে সেনাবাহিনী নিজেদের জমি ফেরত চায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ৪টিসহ ৫০ মডেল মসজিদ উদ্বোধন করবেন আজ প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধ৫২ লাখ ২৯ হাজার টাকা বকেয়া পৌরকর ও ট্রেড লাইসেন্স ফি আদায়