১৯৯৭ সাল থেকে নগরবাসী সড়কটির স্বপ্ন দেখলেও গত ২৪ বছরে পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যাশার ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডে কিন্তু দুর্গতি পিছু ছাড়ছে না। অনানুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলেও পাহাড় ধসের কারণে আবারও তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে পাহাড়ের পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণসহ পাহাড় ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করে সড়কটি চালু করার কথা বলছে সিডিএ। তবে তা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সিডিএর শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রথম বাইপাস সড়ক। নগরীর বিস্তৃত এলাকাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাটে যুক্ত হওয়ার এই স্বপ্ন প্রথম দেখা হয় ১৯৯৭ সালে। ওই সময় ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণের প্রকল্প নেয় সিডিএ।
১৯৯৯ সালে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়। ২০০৪ সালে এসে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়কটি নির্মাণের জন্য ৫৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। ফৌজদারহাট থেকে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। রাস্তাটির বেশিরভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর আপত্তি তোলে এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটি। এই রাস্তার জন্য যখন ভূমি হুকুম দখল করা হয় তখন উইম্যান ইউনিভার্সিটিকে ১০৪ একর ভূমি প্রদান করা হয়েছিল। রাস্তা নির্মানের সময় দেখা যায় প্রায় ৪ হাজার ফুট বা ১.২২ কিলোমিটার রাস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ একর এলাকার মধ্যে পড়েছে। এতে করে রাস্তাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে পড়ে। ওই এলাকায় রাস্তা নির্মাণ প্রায় শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভেতর দিয়ে রাস্তা যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি তোলে। তারা ক্যাম্পাসের বাইরের অংশ দিয়ে নতুন করে রাস্তা তৈরির দাবি জানায়। ক্যাম্পাসের ভেতরের রাস্তাটি অভ্যন্তরীণ রোড হিসেবে ব্যবহার করবে-এমন শর্তও জুড়ে দেয়। সিডিএ তাদের দাবির বিরোধিতা করে। এতে করে বেঁকে বসে বিদেশি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠানটি সিলেট চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। ওই অবস্থায় রাস্তাটি নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দিকে পাহাড় খাঁড়া হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়ে যায় পুরো প্রকল্প।
পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটির ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশ ঘেঁষে নতুন করে রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। নতুন করে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় প্রায় ২১০ কোটি টাকা। পরে কাটছাঁট করে প্রকল্প ব্যয় ১৭২ কোটি ৪৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি পায়। আগে করা কাজগুলোও পরিত্যক্ত হওয়ায় নতুন করে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৩২০ কোটি টাকায়।
ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটির জন্য ৯১৯.৭৮ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ৬টি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। কয়েকটি কালভার্টও রয়েছে। নতুন করে পাহাড় কেটে নির্মাণ করতে হয় রাস্তা। এই পাহাড় কাটা নিয়ে শুরু হয় ঝামেলা। রাস্তাটি নির্মাণকালে সিডিএ ছোট-বড় ১৭টি পাহাড় কাটে। এর মধ্যে ৭টি পাহাড় কাটা হয়েছে একেবারে খাঁড়াভাবে।
পাহাড় কাটার সময় কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হয়নি। পাহাড় ব্যবস্থাপনার নিয়মও অনুসরণ করা হয়নি। খাঁড়া পাহাড় কেটে পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে সিডিএকে দশ কোটি টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাহাড়গুলোর ব্যবস্থাপনা ঠিক করার জন্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সিডিএ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি পাহাড় ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের পরামর্শ দেয়। এদিকে সাম্প্রতিক বর্ষণে রাস্তাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। তাই আরো বড় ধসের আশঙ্কায় রাস্তাটি আগামী তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিডিএ সূত্র জানায়, এই তিন মাসের মধ্যে পাহাড় ব্যবস্থাপনাসহ রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ শেষ করে রাস্তাটি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটির পাশে দুই-তিনটি পাহাড় থেকে বেশ কিছু মাটি এবং পাথর ধসে পড়েছে। রাস্তার ওই অংশের কাজ শেষ না হওয়ায় ওদিকে গাড়ি চলাচল আগে থেকে বন্ধ ছিল। তবে রাস্তাটিতে প্রতি শুক্র এবং শনিবার যে পরিমাণ পর্যটক ভিড় করেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা শংকিত। তাই রাস্তাটি তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট এবং নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা হবে। এরপর চালু করা হবে।
তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র সংশয় ব্যক্ত করে বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে পাহাড় ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করে রাস্তাটি চালু করা সম্ভব হবে না। খাঁড়া পাহাড়গুলো রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি যেসব নির্দেশনা দিয়েছে কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা সম্পন্ন করতে আরো সময় লাগবে।









