৭ই জুন ঐতিহাসিক ৬-দফা দিবস। বাঙালির মুক্তির সনদ হচ্ছে এই ৬-দফা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বুনে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নবীজ। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে বাঙালি ধাপে ধাপে প্রস্তুত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে গত বছর ১৭ মার্চ থেকে এক বছর ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ অতিথিদের নিয়ে মুজিববর্ষের কর্মসূচির উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা স্থগিত করা হয়।পরে সীমিত পরিসরে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানের আয়োজন আগে থেকেই রেকর্ড করে ১৭ মার্চ রাত ৮টায় দেশের সব টিভি চ্যানেলে আনুষ্ঠানিকভাবে সমপ্রচার করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর ৭ই জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস অনলাইনে উদযাপন করেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে যেমনি পাক ভারত উপমহাদেশের জনগণ ব্রিটিশ শোষকদের এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য ঐক্যমত হয়েছিল, ঠিক তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের এইদিনে ঘোষিত ৬-দফাকে তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণ পশ্চিমাদের এদেশ থেকে তাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
ছয় দফা বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’। বহুকাল থেকে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি ‘ছয় দফা দাবী’ প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছিল। শাসক গোষ্ঠী তাকে রুখতে না পেরে বাধ্য হয়ে ছয় দফা প্রচার কালে ১৯৬৬ সালের ৯ মে গ্রেফতার করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার বীর বাঙালিকে দামাতে পারেনি। ৬ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বঙ্গবন্ধুর আহবানে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৭ জুন তাই ‘ছয় দফা দিবস’। বঙ্গবন্ধু ছয় দফায় বলেছিলেন, ১নং দফা-এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টরী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। ২নং দফা- এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।৩নং দফা-এই দফায় বলা হইয়াছে মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অল্টারনেটিভ প্রস্তাব। এই দুইটি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণ করিলেই চলিবেঃ ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পুর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট’ ব্যাংক থাকিবে। খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। ৪নং দফা-এই দফায় বলা হইয়াছে সকল প্রকার ট্যাঙ, খাজনা, কর ধায্য ও আদায়ের ক্ষমতা থকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিকক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে। ৫নং দফা-এই দফায় বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করেনঃ ১। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। ২। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে। ৩। ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে। ৪। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী রফতানী চলিবে। ৫। ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। ৬নং দফা-এই দফায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করেন। এ দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয় । কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানীর বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? ৬ দফায় বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, মুরুব্বিদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সব সহ্য করিবার মত মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাঁর পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনে কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাই বোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি। ”
এছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ও এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিষয়ে তরুণ প্রজন্মকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসজনিত বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন ডিজিটাল মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
লেখক : সাংস্কৃতিক সংগঠক