চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সরিষা বীজ ঘোষণায় সম্প্রতি আমদানি নিষিদ্ধ পপি সীডস বা পোস্তদানা নিয়ে এসেছেন পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী সৈয়দ রাজু আহমেদ। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো-তার প্রতিষ্ঠান আজমাইন ট্রেড সেন্টারের নামে এটিই ছিল প্রথম আমদানি। প্রথম আমদানিতেই বড় জালিয়াতির ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কাস্টমসের কর্মকর্তারা বলছেন, কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে চেক করে দেখা গেছে-আজমাইন ট্রেড সেন্টারের নামে আগে কখনো পণ্য আমদানি হয়নি। আমদানি নথিতে তিনি যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন,সেটিও অস্তিত্বহীন। একইভাবে চালানটি খালাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএন্ডএফ এজেন্ট অখিল চন্দ্র মণ্ডলের মালিকানাধীন হটলাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনালেরও ঠিকানারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম আমদানিকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়। প্রথম আমদানি সব সময়ই রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে পড়ে। পোস্তদানা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য হওয়ায় বিভিন্ন শস্যবীজের ঘোষণায় পণ্যটি দেশে নিয়ে আসে অসাধু আমদানিকারকরা। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে সরিষা বীজ আমদানি। খুব বেশি বাজার চাহিদা না থাকার পরও আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১২ আমদানিকারক ৫ হাজার ৮৯৪ টন সরিষা আমদানি করেন। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) পর্যন্ত ২৪ জন সরিষা বীজ আমদানি করেন ১৮ হাজার ৩৩২ টন। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। পরিমাণ হিসেবে ১২ হাজার ৪৩৮ টন বেশি। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বাজারে সরিষা বীজের চাহিদা খুব বেশি নয়। কারণ সরিষা বীজ সাধারণ মানুষের কাজে আসে না। তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরিষা বীজের প্রধান ভোক্তা। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, বাজারে সরিষা বীজের খুব বেশি চাহিদা নেই। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ (৩৭.৩২ কেজি) সরিষা বীজ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। এক বছর আগে তা ছিল ২ হাজার টাকা।
আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো একটি পণ্য দুই তিনগুণ বেড়ে যাওয়ার পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাজার চাহিদা। সরিষা বীজ ঘোষণায় যেহেতু ক’দিন আগে আমদানি নিষিদ্ধ পোস্তদানা এসেছে, তাই অতীতে আসা চালানগুলোর মধ্যে যে পোস্তদানা আসেনি, তা বলা মুশকিল। সাদৃশ্য থাকায় অনেক অসাধু আমদানিকারক সরিষা বীজ ঘোষণায় পোস্তদানা নিয়ে আসেন। অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি নিষিদ্ধ পোস্তা দানা আমদানির ঘটনায় গত ৩ জুন বন্দর থানায় আমদানিকারক সৈয়দ রাজু আহমেদ এবং সিএন্ডএফ এজেন্টের মালিক অখিল চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তাকমিম হাসান মামলা করেন। চালানটি আমদানির মাধ্যমে কোনো অর্থপাচার হয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছে কাস্টমসে এন্টি মানি লন্ডারিং ইউনিট। মানি লন্ডারিংয়ে ইউনিটের দায়িত্বরত উপ-কমিশনার মো সালাউদ্দিন রিজভী দৈনিক আজাদীকে বলেন, চালানটি সবে মাত্র আটক হয়েছে। আমরা শিগগিরই এটি নিয়ে কাজ শুরু করবো। মানি লন্ডারিংয়ের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমতিক্রমে মামলা দেয়া হবে।
মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির বিষয়ে জানার জন্য আজমাইন ট্রেড সেন্টারের মালিক সৈয়দ রাজু আহমেদকে ফোন করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া সিএন্ডএফ এজেন্ট হটলাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনালের মালিক অখিল চন্দ্র মণ্ডলের নম্বরে ফোন করা হলে ফোন রিসিভকারী বলেন- এটি অখিল চন্দ্র মণ্ডলের নম্বর নয়, আমার নাম মোরসালিন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো.ফখরুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরকারি রাজস্ব সুরক্ষায় চট্টগ্রাম কাস্টমস সব সময় তৎপর রয়েছে। করোনার মধ্যেও আমরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। যেসব চালানে অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোতে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি।
অপরদিকে কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মিথ্যা ঘোষণা এবং ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আনার সংবাদ পাওয়ায় এক হাজার ৭৩৯টি চালান লক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে ৭৪১টি চালানে ৪৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে আমদানিকারক। মিথ্যা ঘোষণা এবং ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আনার দায়ে এসব চালানে ৫৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকাসহ মোট ১০৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে অভিযোগ রয়েছে- একশ্রেণীর অসাধু আমদানিকারকের সাথে যোগসাজশ করে কিছু কাস্টমস কর্মকর্তা মিথ্যা ঘোষণার পণ্য ছাড় করতে সহায়তা করেন। ফলে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এসওএল ডেল্টা নামের জাহাজযোগে গত ১৮ এপ্রিল মালয়েশিয়া থেকে সরিষা বীজ ঘোষণায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের দুই কন্টেনার পোস্তদানা নিয়ে আসে আজমাইন ট্রেড সেন্টারের মালিক রাজু আহমেদ। এছাড়া শিপিং এজেন্ট ছিল আলভি লাইন বাংলাদেশ। অন্যদিকে চালানটি খালাসে একইদিন সিএন্ডএফ এজেন্ট বিল অব এন্ট্রি দাাখিল করে। ঘোষিত সরিষার বীজের শুল্ক বাবদ এক লাখ ৪২ হাজার ৪৯৭ টাকা পরিশোধও করে আমদানিকারক। গোপন সংবাদ থাকায় চালানটির কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায়, ঘোষণা দেয়া ৫৪ টন সরিষা বীজের স্থলে ১২ টন পাওয়া যায় এবং বাকি ৪২ টন আমদানি নিষিদ্ধ পপি সিডস দেখতে পান। পরে পণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা শেষে পপি সীডস বা পোস্তদানা আমদানি নিশ্চিত হয়ে চালানটি জব্দ করা হয়।