কোভিড ১৯ ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানো প্রতিরোধে সবচেয়ে সহজ সুলভ কার্যকরী উপায় হলো মাস্ক লাগানোসহ কিছু স্বাস্থ্য বিধি। এসব প্রচার করা হচ্ছে জনগণের অবগতির জন্য। সচেতনতার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে আইনের বিধিবিধান শাসন ও শাস্তি। অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রের মত এখানেও আছে ধোঁয়াশা। এর ফলে ভুলের ব্যাপকতা আর নিজে যা বুঝলাম তার ডামাডোল হচ্ছে। জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হচ্ছে। তাদের অনীহা ও অগ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হচ্ছে। আর অন্যদিকে আমলাদের দাপটের ইচ্ছাপূরণ হচ্ছে।
কদিন আগে একজন মহিলা গাড়ি চালক ও সহযাত্রীকে মাস্ক না পরার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আটকালো ও লাইসেন্স তলব করেছে। প্রথমত গাড়ির ভিতরে মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই, কারণ মাস্ক অন্যের কাছ থেকে নিজকে রক্ষার জন্য বা অন্যকে নিজের থেকে রক্ষার জন্য, যাতে মূলত লক্ষণহীনভাবে থাকা ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের কাছে না যেতে পারে। সহযাত্রীও একই যাত্রা শুরু থেকে শেষে ধাবিত এবং একই বদ্ধ গাড়িতে। হয়ত যাত্রার শুরু ও শেষের স্থান একই। তাই মাস্কের প্রয়োজন নেই। বরং ছোট আবদ্ধ স্থানে মাস্কের ব্যবহার ক্ষতিকর হতে পারে। অন্যদিকে মাস্ক ব্যবহার না করা ড্রাইভিং ও ট্রাফিক আইনের আওতাভুক্ত নয়। এখানে আইন প্রয়োগকারীর অজ্ঞতা ও অন্যদিকে দাপট দেখান হলো। যার জন্য ভোগান্তির শিকার হলেন গাড়ি চালক ও সহযাত্রী।
বার বার ছোট করে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য। কিন্তু অনেক অনেক স্বাস্থ্যবিধি আছে। কোন স্বাস্থ্যবিধি? এখানে কোন স্পষ্টকরণ নেই। ফলে যে যার মত করে ব্যাখ্যা করছে। আইন প্রয়োগকারীরা একরকম আর ব্যবহারকারীরা অন্যরকম। যেহেতু আইন প্রয়োগকারীদের হাতে আইনের অস্ত্র আছে, তাই তাদের প্রতীতিই শেষ কথা। আমাদের দেশের আইন প্রয়োগকারীগণ কারো কথা শুনে না, যা বুঝে সেটাই শেষ কথা। তারা আইনের লেখাটাই হয়ত বুঝে কিন্তুু তার স্পিরিট বা প্রাণের পরশ এক্কেবারেই না। তাদের মাইন্ডসেট বৃত্তে বন্দী। তাই তারা যা বুঝে তা রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’র মত ক্ষমতা দেখানোর জন্যই করে। না হলে ছাগলের বিচারের জন্য মোবাইলকোর্ট বসিয়ে জরিমানা অতঃপর জরিমানার টাকা আদায়ের জন্য ছাগল বিক্রি, মাস্ক না পরার জন্য বাজারের মধ্যে গ্রামের বুড়ো মানুষদের নিজেদের কান ধরে উঠাবসা করানো ও তার ভিডিও ক্লিপ মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে আপলোড, আরও অনেক কিছু। প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে যা দেখা যায়। আইন প্রয়োগের নামে ইচ্ছা ও ক্ষমতাদর্প প্রদর্শনতন্ত্র।
এসব কিছু হচ্ছে নির্দেশনা ও বিধির স্পষ্টকরণের অভাবে। এক অনভিপ্রেত ধোঁয়াশার কারণে। যা বাংলাদেশের প্রায় সকল আইনেই আছে। কারণ যারা এগুলো তৈরী করে তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই করে। অনেক সময় আইনজারির পর আবার তা সংশোধন বা বাতিল করতে হয়।
জনগণের সার্বিক মেনে চলার জন্য প্রয়োজন স্পষ্টিকরণ। গাইডলাইন। বাস্তব সম্মত। প্রতিটি পর্যায় ও পটভূমি ও ব্যতিক্রমে প্রয়োগযোগ্য। যা বলা হয় এসওপি বা স্টেনডার্ড অপারেশন প্রসিজিওর। যাতে সম্ভাব্য সব পরিস্থিতিতে কার্যকর করার পন্থা থাকে। এসওপিতে থাকবে : কি, কেন, কোথায়, কিভাবে, কখন, কাকে। এসওপি তৈরী করবে বিশেষজ্ঞগণ এবং টেকনিকেল কমিটি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে। এই এসওপি ছড়িয়ে দিতে হবে সার্বিক বোধগম্য আইসি (ইনফরমেশন, এডুকেশন, কমুনিকেশন) কৌশলপত্রের মাধ্যমে। পোস্টার, ফ্লাইয়ার, লিফলেট, মিডিয়া ক্লিপ ইত্যাদির দ্বারা।
মাস্কের ব্যবহার ও পরিধি এবং প্রেক্ষাপট স্পষ্টকরণ করতে হবে। ঠিক তেমনি শুধু স্বাস্থ্যবিধি না বলে জনমনে সহজবোধ্য পরিষ্কার স্পষ্ট ধারণা ও কার্যকর নির্দেশনা দেয়ার জন্য বলতে হবে ‘কোভিড১৯ প্রতিরোধ স্বাস্থ্যবিধি’। যাতে মাস্কও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর ফলে ধোঁয়াশা দূরীভূত হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যারা প্রয়োগ করবেন এবং প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ ও পরিবীক্ষণ করবেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের জানতে হবে কোথায় কোথায় ব্যতিক্রম হবে। তারা যেন পর্যবেক্ষক, পরিবীক্ষক এবং নিরীক্ষকের পরিধি ও প্রেক্ষাপটের সীমানা লঙ্ঘন করে বিশেষজ্ঞ না বনে যায় এবং যেন ভুলে না যায় যে তাদের প্রধান কাজ সহায়তা এবং জনগণই হলো দেশের মালিক। এজন্য পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ, নিরীক্ষণ ও প্রয়োগ এসওপি তৈরী করতে হবে এবং তা পালন করতে হবে। এভাবেই শুধু ধোঁয়াশা মিলিয়ে গিয়ে যথাযথ কোভিড১৯ স্বাস্থ্যবিধি পালিত হলে প্রতিরোধ ফলপ্রসূ হবে এবং ভোগান্তির অপনোদন হবে।
লেখক : বিশেষজ্ঞ মেডিসিন ও নেফ্রোলজী এবং গবেষক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ