সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় খুনের আগে স্ত্রী মিতুকে অন্ত:ত চারবার খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন। শুধু তাই নয়, তিনি এও জানিয়েছেন মুছাকে না পাওয়ার পেছনেও বাবুল আক্তারের হাত রয়েছে। পিবিআইয়ের আগে বাবুল আক্তারের দায়েরকৃত মিতু হত্যা মামলা তদন্ত করেছিলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান। তদন্তে যথেষ্ট গাফেলতির অভিযোগ এনে মোশারফ হোসেন বলেন, সেই সময় তিনি তদন্তে যথেষ্ট গাফেলতি করেছিলেন। কেন করেছিলেন, তা জানতে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হোক। তিনি বলেন, “আমার মেয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রাণ দিয়েছে। বাবুল জেলে। আমার নাতি নাতনি দুটোকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে জানি না। আমি জীবদ্দশায় আমার মেয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখে যেতে চাই।” মিতু হত্যাকান্ডের পাঁচ বছরের মাথায় গতকাল আজাদীর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর বাবা এসব কথা বলেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলে মাহিরকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে খুন হন মাহমুদা খাতুন মিতু। জঙ্গি বিরোধী কর্মকান্ডে স্বামী বাবুল আক্তার তখন দেশজুড়ে সুপরিচিত। তাই মিতু হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সকলেই ধরে নেয় জঙ্গি গোষ্ঠী বাবুল আক্তারকে ‘শিক্ষা’ দিতে তার স্ত্রীকে খুন করেছে। দেশের আনাচে কানাচে সাধারণ মানুষ পথে পথে , মানববন্ধন, সমাবেশ থেকে মিতুর হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি উঠে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে একের পর এক রঙ পাল্টাতে থাকে মিতু হত্যা মামলা। বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে নগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে পিবিআইয়ের হাতে মামলাটির তদন্ত ভার দেয়ার পর থলের বিড়াল বের হতে থাকে। তথ্য প্রমাণে বের হয়ে আসে, মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী বাবুল আক্তার নিজেই। বাদী থেকে স্বামী হন আসামি।
মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন বলেন, পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো আমি বিশ্বাস করি যে, আমার মেয়ে হত্যার বিচার আমি পাবো। পিবিআইয়ের তদন্তে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। বাবুল আক্তার আদালতে স্বীকারোক্তি না দিলে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ সে আসামি। স্বীকার কইরাও উল্টে যাইতে পারে। বলতে পারে, টর্চার কইরা আমারে স্বীকার করাইছে। স্বীকার না করলেও তার বিরুদ্ধে যেসব এভিডেন্স পাইছে বা আরো কোন এভিডেন্স থাকলে সেগুলো কালেক্ট কইরা যদি আদালতে পাঠাইতে পারে, তবে কোন সমস্যা হবে না। ” তিনি বলেন, “যেমন ধরেন, টাকার লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুছাকে চিনেও না চেনার ভান করেছে সে। প্রথম মামলার বাদী সে। চাইলে মুছারে সেখানে আসামি করতে পারতো। করে নাই। তার সাথে আমরা যোগ করেছি গায়ত্রীর প্রসঙ্গটা, পরকীয়ার প্রসঙ্গটা। তার হাতের লেখা, গায়ত্রীর হাতের লেখা, আবার গায়ত্রী যে ম্যাসেজ পাঠাইছে, সেখানে প্রেমের কথাও আছে, মিতুরে হুমকির কথাও আছে। এ কানেকশনে যদি সাক্ষীটা হয় তবে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
তিনি বলেন, “প্রথম মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সেই সময়ের এসি কামরুজ্জামানরে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন আছে। সে আমাদের একটু চাপের মুখে রাখছিল। সে আমাদের কথা শুনতে চায় নাই। গায়ত্রীর দেওয়া বই, ২৯ টা ম্যাসেজ, সব তারে ফটোকপি কইরা দিছি, সে আমলে নেয় নাই। ঢাকায় যে বাবুলরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হইছে, সেখানে আগের আইও কী পাইছে, সম্পৃক্ততা পাইলে সেটা ডায়েরিতে উল্লেখ করছে কিনা তা জানা দরকার। সেখানে আইওসহ আট জন ছিল। তারা যদি বলে যে, বাবুল আক্তার স্বীকার করছে এবং স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ছে, এটাও কিন্তু একটা ডকুমেন্ট। আমার কথা হলো- তারা মামলার সাক্ষীও হবে না, আসামীও হবে না। বিষয়টা জানার জন্য সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। তার এক ঘনিষ্ট বন্ধু আছে চট্টগ্রামে, মজিবুর রহমান। সেও অনেক কিছু জানে। যেহেতু এখন মামলা হয়েছে, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, এখন সে যেন কোন ভাবে সরতে না পারে। সরে গেলেতো বিপদ।”
২০১৬ সালের ৫ জুন মিতুকে হত্যা করা হয়। তবে তার বাবা অভিযোগ করেছেন, এর আগে অন্ত:ত চারবার মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করে বাবুল আক্তার। তিনি বলেন, সুদানে মিশনে থাকাবস্থায় একবার এবং চীনে দুইবার থাকাবস্থায় দেশে মিতুকে খুনের চেষ্টা করা হয়। এছাড়া দেশে বাবুল মিতুকে জানিয়েছিল, জঙ্গিরা তার বাসা চিনে ফেলেছে , তাকে টার্গেট করেছে। বাসা পাল্টাতে হবে। তুমি বাসা খোঁজো। মিতু বাসা খুঁজতে যাওয়া আসার পথে একবার তাকে খুনের পরিকল্পনা করে বাবুল। আর যেই দিন খুন হলো, সেদিনের ঘটনাতো সবাই জানে। মাহিরের স্কুলের বাস আসার আধাঘন্টা আগে ম্যাসেজ দেয়া হয় বাস আসার। খুন হয় আমার মিতু।
মিতুর উপর নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে মোশারফ হোসেন বলেন, মিতু অনেক আগে থেকে তার মাকে বিষয়গুলো জানিয়েছিল। আমার মেয়ে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। বাচ্চাদের কথা ভেবে সংসার ছাড়তে চায় নি। অথচ বাবুলের বাবা-মা ভাইবোন চাইছিল সংসারটা ভাঙুক। তার মা ছেড়ে চলে আসতে বলেছিল। ও বলতো, মা দেখি, ও ভালো হয়ে যাবে, সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করবে। এখন কী হলো? মিতুর উপর নির্যাতনের সাক্ষী তার ছেলে মাহির, অর্ডারলি কন্সটেবল সাদ্দাম আর কাজের বুয়া। ঘটনার পর বাবুলকে নিজ বাসায় আশ্রয় দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় তার সিনটা দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। আর মিতুর উপর নির্যাতনের বিষয়গুলো শতভাগ নিশ্চিত হয়েছি তার মৃত্যুর পর, ফ্ল্যাটের অন্যান্য প্রতিবেশিদের থেকে।
মুছার নিখোঁজ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, মুছার ওয়াইফ যেটা বলছে, মুছারে কয়েকজন অফিসার যে নিয়া আসছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। কারণ মুছা যখন নিখোঁজ হইলো তখন কিন্তু বাবুলের চাকরি ছিল। আর তার চাকরি চলে যাবে, এমন কথাও উঠে নাই। শুধু তাই নয়, মুছারে যারা নিয়ে এসেছে, তারা বাবুলের সাথে চাকরি করেছে। পুলিশ যেহেতু বলছে না যে, মুছা নাই, কাজেই সে অপহরণ হোক বা গ্রেপ্তার হোক, যা হয়েছে তা বাবুলের গাইডলাইনে হয়েছে। এটা আমাদের চেয়ে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো ভালো জানেন। এখন তার বউ মামলা করতে পারে।
নাতি নাতনি মাহির ও টাপুরের বিষয়ে তিনি বলেন, বাবুল এখন জেলে, আমার মেয়ে নাই। এ অবস্থায় আমার নাতি নাতনি দুটোকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে জানি না। তাদের সন্ধানে গত মাসের ১৯ তারিখ এডিএম কোর্ট থেকে বাবুলের বাসায়, তার বাবা, ও বোনের বাসায় সার্চ ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়েছে। তাদের ৩১ মের মধ্যে স্থানীয় থানায় জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা হাজিরও করে নাই, জবাবও দেয় নাই। কোর্ট পুনরায় ৮ জুন সময় দিয়েছে। এর মধ্যে হাজির না করলে কোর্ট আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
মোশারফ হোসেন বলেন, এ মামলাটা ২০১৬ সালেই হতে পারতো। হলো ৫ বছর পরে। আমি সবসময় বলেছি মামলা থেকে বাবুলকে বাদ দিলে আমি নারাজি দেবো। অনেকে বলেন, তখন মামলা করি নি কেন। কারণ হলো, একই ঘটনায় দুইটি মামলা হয় না। একটা মামলা শেষ হলে দ্বিতীয়টি শুরু হয়। তাই এখন মামলাটি করা। তিনি বলেন, এটি কেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মিতুর উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, আমি নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে পৃথক আরেকটি মামলা করতে পারি। চলমান মামলাটির ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করে দেবে ওই মামলাটি করবো কি-না। আমি চাই সত্যটা বেরিয়ে আসুক। চাই না কেউ অযথা হয়রানি হোক। তাছাড়া নিজে পুলিশ ছিলাম বলে পুলিশী কাজে কখনো ব্যাঘাত ঘটাই নি। পিবিআইয়ের আন্তরিকতায় আমি আশাবাদী সত্য উদঘাটিত হবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে।