চল্লিশ ছুঁই ছুঁই শিরিন, নিপাট গৃহিণী। স্বামী, সন্তান আর গেরস্থালী নিয়েই তার জীবন। ঘরের দেখভাল যেহেতু তার হাতেই ন্যাস্ত তাই একটু-আধটু টেনশনে ভুগেই থাকেন শিরিন। কিন্তু করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তার টেনশন যেনো আরও বেড়ে গেলো। লকডাউনের সময়টা বাদে তার স্বামীকে দাপ্তরিক কাজে বাইরে বেরুতেই হলো। ফলে সংক্রমণের একটা ঝুঁকি তো থাকেই। কিছুদিন পর খাওয়া-দাওয়া কমে যেতে থাকে শিরিনের। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। রাতে ঘুম কমে যায়, শুধু হাঁটাহাঁটি করেন, বারে বারে স্বামী-সন্তানের শরীরে হাত দিয়ে দেখেন গা-গরম কীনা। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বেড়ে যাওয়ায়, তাকে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন মারাত্মক মানসিক রোগে আক্রান্ত শিরিন।
যে-কোনো দুর্যোগে নারী, শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বিপদাপন্ন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকে। এ-পরিস্থিতিতে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব আমাদের মনের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে, যা অনেকের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। করোনার কারণে সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার বিষয়টি মানুষের মনে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে। অনেক পরিবারে নারীই প্রাথমিক ও একমাত্র সেবাদানকারী। যে-কোনো সংকটে তার কাজের চাপ ও মানসিক চাপ বহুগুণ বেড়ে যায়। এ-সময় শিশুদের ক্ষেত্রে সম্মিলিত বিকাশ বাধাগ্রস্থ করতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং শিশুর উপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। পাশপাশি পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের বিষণ্নতা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আবার মহামারী পরিস্থিতি থিতু হলে বা চলে গেলেও নারী ও শিশুদের মাঝে মানসিক সমস্যা দেখা যায়। দীর্ঘদিন ঘরে থাকা, প্রিয় মানুষদের সংস্পর্শহীনতা, কােেছর কোনো প্রিয়জনের বিয়োগ, আর্থিক অনটন ইত্যাদি বাস্তব প্রতিকূলতার কারণে ব্যক্তির মাঝে একাকিত্বের অনুভূতি, অস্থিরতা ও মনোদৈহিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। শিশুদের মাঝে দেখা যায় খিটখিটে ভাব, অতিরিক্ত জেদ, অমনোযোগিতা ইত্যাদি লক্ষণ। মহামারী পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নাগরিক বলছেন যে করোনাভাইরাস দুর্যোগ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। শিশুদের মধ্যে এ-হার এক শতাংশ। দেশে প্রায় ষাট লাখ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। করোনাকালে এ-হার বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে দেশে পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার প্রায় দ্বিগুণ। তাহলে উপায়? করোনাকালীন মহামারিতে পরিবারে নারীর প্রতি অধিক যত্নবান হতে হবে। এই মহামারির সময়টিতে পর্যাপ্ত ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদের মন ও শরীর দুটোই ভালো রাখবে। নারীর প্রয়োজনগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা পরিহার করতে হবে। এই সময় বাড়ির শিশু ও বয়স্কদের বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। বয়স্ক মানুষটি হঠাৎ শিশুর মতো অবুঝ হয়ে উঠতে পারেন। শিশুরা খিটখিটে ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে, বিশেষ করে তাদের সামনে কোনো ধরনের ঝগড়া ও সহিংসতা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে বাগান করা, বই পড়া, পোষা পশুপাখিকে আদর করলেও ভালো অনুভূত হয়। যারা একা থাকেন বা যাদের পোষা পশুপাখি নেই, তাদের জন্য নিয়মিত ঘুম, শরীর চর্চা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা, ভার্চুয়ালি আত্মীয়স্বজন, কাছের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, গান শোনা, সিনেমা দেখার মতো বিনোদন, ছবি আঁকা, এমনকি রান্না করাও মানসিক চাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া সৃষ্টিশীল কাজ ও অন্যকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েও মন ভালো রাখা যায়।
মানসিক রোগের চিকিৎসা শুধু ওষুধনির্ভর নয়, অনেকটাই কাউন্সেলিং নির্ভর। মানসিক রোগের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং দেশব্যাপী আটটি রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তৈরি হওয়া মানসিক সমস্যার পরবর্তী সুনামি মোকাবেলায় এ অঙ্গনের পেশাজীবীদের যার যার অবস্থান থেকে তৈরি থাকতে তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই এ-বিষয়ে এখনই সজাগ হওয়া প্রয়োজন। পরিবারের নারী সদস্য এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই দেখা উচিৎ।